- না না রথীদা , একদম মানা আজ শুনবই না, তুমি তো জানো আমি কী প্রচন্ড
জেদি।
- আরে সমীর ,আচ্ছা মুশকিলে ফেলেছো,আমার থেকে কতো
সিনিয়র লেখক রয়েছেন ? কী করতে কী হবে,তোমার মুখ লুকানোর জায়গা থাকবেনা তখন।
- আমার মুখের দায়ভার আমার রথীদা,তুমি শুধু তোমার
মুখমন্ডল আমার পেজে দেখাও একটিবার । আরে, তুমি হলে আমাদের এই ক্ষুদ্র লেখা-লেখির গ্যালাক্সির উজ্জ্বল সুপার নোভা। এই সময়ের অসমের
একটা সাহিত্য আসর হয় বলো যেখানে তোমার লেখার কথা ওঠে না? তুমি ছাড়া আমার এই অনলাইন
লাইভ প্রোগ্রাম কে শুভারম্ভ করবে? আমি এড
দিয়ে দিয়েছি অলরেডি,কতো লাইক আর কমেন্টের বন্যা কি বলবো !
- সুপার নোভা? জানো তো সুপার নোভা কেন এত উজ্জ্বল
হয়? ফেটে মৃত্যুর অটল আঁধারে ডুববে বলে,অনেকটা পিদিমের তেল বিহীন সলতে। তা যখন
বলেই ফেলেছো,তোমাকে আর বিপদে কি করে ফেলি?তবে বলিয়া ফেলো সখা কী মোর করণীয়? কোন রাজদন্ড ভাবিয়া রাখিয়াছ ?
- ধুস, অতো কিছু না। তুমি লাইভ আসবে, আড্ডা ছলে
গল্প নিয়ে দু চার কথা,কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর এবং অবশ্যই এই লক-ডাউন সম্পর্কিত কোন
ছোট বা মাঝারী গল্প পাঠ। আসলে আমরা এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে লোকেদের বোঝাতে চাইছি
ঘরে থেকেও মনকে কতটা ক্রিয়েটিভ রাখা যায়।
- আমার আর ঘরে থাকা, জানো তো ব্যাংকের কর্মীর কী
লক-ডাউন? প্রতি একদিন অন্তর যাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে বড় ব্রাঞ্চে থাকলে ভাল হতো ,দু
দিন করে ছুটি পাওয়া যেতো।
- ও তুমি কলম ছুঁলেই লেখা। তবে দেখা হবে। আজ রাত
৯ টায় , অপেক্ষায় থাকবো।
সকালের কথাগুলো আবার মনে পড়লো
রথীজিতের। সমীর বরাবর এমন খামখেয়ালী, অথচ ছেলেটার এমন অদ্ভুত মায়া মানা করা যায় না।
কিন্তু সমীর কে বলা হয়নি এই লক-ডাউনে সাহিত্যিক রথীজিৎ মুখার্জী কোনো করোনা নিয়ে
লেখা লেখে নি। সে এ কয়দিন ডুব দিয়েছে তার ছোটবেলার স্মৃতি, সেই আধ শহুরে গ্রামে। রথী
বরাবর এই সিক্রেসি মেন্টেন করে, শেষ হওয়ার আগে কাউকে কিচ্ছুটি জানানো চলবে না। আজ
একখানা গল্প লিখতেই হবে রাত ৯টার আগে, সকলকে তাক
লাগিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা যায়?
রথী এই অল্প বয়সে নামযশ আসলে প্রচন্ড
উপভোগ করে। সমীর আগেই বলেছিল একটা ফেসবুক লাইভ করবে, জানতো ওর ডাক আসবে,কিন্তু
একেবারে ওপেনিংএ ডাকা বাড়াবাড়ি করে ফেললো । অবশ্য, এখন মুখ দেখলে যে কেউ পড়ে ফেলবে
যে এই বাড়াবাড়ি রথীর কাছে কতটা সুখকর। লক-ডাউন নিয়ে একটা হট কেক বেইক করা কি মুখের
কথা ? দু একজন টাইপ করে নিজের পেজে দেবে, তারপর কতো কতো শেয়ার, বাচিক শিল্পীরা রেকর্ড করবেন ,কেউ কেউ ফটো জুড়বেন ইন্টারনেট
থেকে, লাইক আর কমমেন্টস ভীড় করে আসবে স্ক্রীনে ।
বেশ
মাখো মাখো একটা প্রেমের গল্প লিখে ফেলা যাক? স্বামী স্ত্রী অনেক দিন পর কাছাকাছি বহুক্ষণ
, টান মনের, টান শরীরের। বিছানায় অনেক দিন
পর চেনা সুবাস,একটু অগোছালো ঘর,রান্নাঘরে দু এক ব্যঞ্জন কম। স্বামীর ফোনে পরকীয়া রিংটোনে
আজ শুধুই মিসডকল।
না।
মোটেই জমবে না, তার উপর সর্বাণী যদি বুঝে যায়,তাহলে আরেক ঝামেলা। কাগজ ছিঁড়ে,
ডাস্টবিনে তাক করে, কেরামের গুটি পকেটে
মারার শট দিল রথী।
তার
চাইতে বিচ্ছেদ ভালো । কতো দিন দেখিনি ভালোবাসা তোমায় , শুধু ইন্দ্রজালের সবুজ আলো বলে
তুমি আছো,কাছেই আছো। তোমার ঠোঁট আজকাল প্রায়েই স্বপ্নে ভেসে আসে। শুধু ঠোঁট দুটো-
নরম, গোলাপী,হালকা নড়ছে । আমি প্রাণপনে চিৎকার করে বলি,- ঐ দুটো ঠোঁট আমার অতি পরিচিত,কতো
শ্রাবণ বসন্তে শুষেছি সব ঘাম, প্রেমের বৃষ্টিবিন্দু। অথচ ওরা কথা বোঝে না, শুধু
প্রমাণপত্র চায়, তুমি কি আমাকে সীলমোহর দিবে?
আজ এই সব কি লিখছে? মনে হচ্ছে কেউ যেন চেলেঞ্জ করেছে ঐ ১০ শব্দ বা ২০, ৫০ ,যাকিছু। এরপর এখন আরো কয়েকজনকে ট্যাগানোর পালা। এভাবে লিখতে আর কাটতে থাকলে এই লেটার প্যাড একটি গল্পেই অক্কা পাবে। আসলে গল্প লেখার থেকে মুনশিয়ানা হলো টপিক। আজকাল সোশাল নেটওয়ার্কিং এ এতো এতো লেখা, এত এত টপিক। আলাদা নাহলে লোকে দুটো লাইন পড়েই হওয়া। তবে যাবার আগে,লাইকের মহিমা ঘোষণায় ভুল হয় না। রথী যুদ্ধ জয়ের আশায় মন প্রস্তুত করে ফেলেছে। দুঃখের গল্প লেখা হবে,পাঠক এই পারফর্মিং আর্ট বা লিটারেচারে দুঃখটা খায় ভাল। এটা ভাবার সাথেই হঠাৎ ওসব রিয়্যালিটি শো নামক চলা অত্যাচারে সাজানো মেকি কান্না ও তার তরতর করে বেড়ে যাওয়া টিআরপি মনে এলো রথীর, মুখে এলো বাঁকা চাঁদের হাসি।
এ কয়দিন ফেসবুকে বেশ কিছু ফটো চোখে
পড়েছে, একটা দুটো বাস আর ভিড় করে আসা শ্রমিকদল, ঠান্ডা পড়লে পরিযায়ী পাখির এভাবেই
দেখা মেলে দীপরবিল জুড়ে। ফেভিকল কোম্পানী বহুযুগ আগেই এই চিত্র নিয়ে এড বানিয়েছিল ।
এই বাস কিছু সৌভাগ্যবান কে বুকে পুড়ে পারি দেয় যথা
সময়,বাকি অকুল সমুদ্রে। হয় সাঁতরে পার হতে হবে, নাহলে গলায় কলসী বাঁধার রশি তৈরি
করতে হবে। অবাক করে দিয়ে এই সব মাটি মানুষের দল এক হাত দিয়ে সাঁতার কাটে,এক হাতে
দড়ি বানায়। আমরা সকলে মিলে গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস উপভোগ করি,পপকর্ণ সহযোগে।
- বাবু একডা কথা আসিলো
যাঃ
,সবে শুরু হলো লেখা আর বাধা। এই বাধায় আজ জড়াবে না বলেই রথীর জোর করে কাস্টমার গ্রিভেন্সে বসা। কাস্টমারপ্রায় নেই বললেই
চলে,গ্রিভেন্স আসবে কোথা থেকে?
- কি?হইসে কি?
এক
সুর মিলিয়ে মুখে ২ কেজি উচ্ছের রস ঢেলে জিজ্ঞেস করল রথী।
- বাবু ৫০০ টেকা পাইসি।
- তো নাচো ,আমি কি করবো ?
- না, মানে, ওই খাতাটা আসলে মায়ের নামে। আমি রতন মণ্ডল,মা সরলা মণ্ডল।
বাবু, ওই খাসায় (খাঁচায়) বওয়া বাবুয়ে কয় মা সাপ (ছাপ ) মারলে টেকা দিব ।
- তো টাকা তোর মা পেয়েছে,তো তোকে দিতে যাবে কোন
দুঃখে ? খালি মায়ের টাকা মেরে মাল খাওয়ার মতলব।
- না বাবু না, মা বুড়া হইসে। আমি এতো দূর হাইট্টা
আইসি, মা কেমনে আইবো কন ?ঘরে খাবার নাই ,বাইরে কাম নাই। ওই টেকাটা
দিয়া দেন না বাবু ।
- আমার মুখে কি লেখা বোকা বলে? ঐ টাকা ঐখানেই
থাকবে রে,উড়ে যাবে না। যা,কাল মাকে নিয়ে আসবি। ব্যাংকের একটা নিয়ম
থাকে তো না কি?
রতন মাথা নিচু করে চলে গেলো। রতনের চলে যাওয়া ছায়াশরীরের
দিকে তাকিয়ে রথী মনে মনে ভাবলো এটা গল্প হলে, আর ও নায়ক হলে নিশ্চয়ই নিজের পকেট
থেকে ১০০ টাকা দিয়ে বলত, “যাও, কাল মাকে কিছু ভাড়া করে নিয়ে এসো।”
যাক আমাদের দুঃখের
গল্প যেন কোথায় ছিল? হা , শ্রমিকেরা শুরু করল পদযাত্রা। আমাদের গল্পের নায়ক
ও তাদের একজন ,নাম কি দেওয়া যায়? রতন মণ্ডল? আচ্ছা সেটাই থাক। না একটা মদ্দা ছেলে হলে শুধু জমবে না, ওর পরিবারও সাথে চলছে
হেঁটে, বউ ও দুটো কচি বাচ্চা,বয়স যা কিছু একটা,কে আর হিসেব রাখছে। রথী মনে মনে সিচুয়েশন
কল্পনা করলো। এ কয়দিন ইন্টারনেট ভাসিয়ে দেওয়া কত কত ছবি চোখের সামনে ভাসছে এক এর
পর এক। একটা ছবি খুব তোলপাড় করেছিল রথীর মন,ফাটা চার জোড়া পায়ের ছবি, পা ফেটে
চামড়া খুলে খুলে পড়ছে। পরে কেউ লিখলো ওই
ছবি এ সময়ের না, পাকিস্তানের। শুনে মনে এক স্বস্তি এসেছিল। স্বস্তি কি
পাকিস্তানের,ভারতের নয় বলে? ভারতের এই মজুরদের পায়ের ছবি কোন ক্যামেরাম্যান কি
তুলেছে?কেমন পা ওদের? অন্যরকম কিছু?
- বাবু, একটা কথা জিগানের আসিল?
সবে দুঃখগুলো গ্রে-সেলে
আঘাত দিচ্ছিলো ,আবার বাধা পড়ল। রথী বিরক্তি সহকারে তাকালো,
এক মধ্য বয়স্ক লোক, অনাহারে হয়তো একটু বেশি বুড়িয়ে গেছে মনে হলো, অবশ্য নেশার
জেরেও হতেই পারে।
- বাবু, সরকারে বলে গরীব মাইনসেরে ৫০০ টেকা দিতেসে?
- হুমম ,তোমার পাসবুক, মানে ঐ খাতা নিয়ে যাও ঐ ৪ নম্বর কাউন্টারে
,দিয়ে দেবে।
- গেসিলম বাবু, কইলো কি সব একান্ট ফেকান্ট লাগবো? কই
পায়?
- বলি কোন জগতে থাকো ?ব্যাংক একাউন্ট যখন বানলো
সরকার,ঘুমিয়ে ছিলে ?
- জানি না বাবু,আমরা তো ঐ ইস্টিশনের পাশে খালি
জায়গায় থাকি। ঐখানে কিছু বানাইসিলো নি?চক্ষে তো পরে নাই?
- গবেট একটা। যাও এইখানে কিছু হবে না। ঐ ৫০০
টাকা সবাই পায় না,তোমার নাম ও নাই, যাও। যাও বলছি ।
লোকটা কি বুঝল বোঝা গেল না, আধময়লা গেঞ্জি দিয়ে চোখ মুছলো
কি একবার? হয়তো তাই। রথী বুঝল মেজাজ ঘেটে ঘ।
কেন যে সরকার এসব ঘোষণা করে? আজকাল
এই লক-ডাউনে এই হয়েছে কাজ। জনে জনে আসে, একবার দেখবে ৫০০ আছে, একবার তুলবে, একবার
বইয়ে লেখবে। মনে হচ্ছে ৫০০ না যেন পঞ্চাশ হাজার।
না, এসব ফালতু কাজে অনেক মাথা ঘামিয়েছে রথী, সময় নষ্ট অনেক
।ওকে এবার ওর কালজয়ী গল্পে ঢুকে পড়তেই হবে। সকলে শুনবে আর চোখে আসবে জল। রাবীন্দ্রীক
কায়দায় বলবে- হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয় ।
- হই দিনু ,এক কাপ চা দিয়ে যা,গল্প জমে উঠেছে।
উজান অতিমারি সংখ্যা (সপ্তদশ সংখ্যা ১৪২৮ ), তিনসুকিয়া, অসম এ প্রকাশিত (ডিসেম্বর,২০২১ )