May 20, 2023

হামসফর ও সঙ্গীরা

 ‘পঞ্ছি নদীয়া পবনকে ঝোঁকে, কোই সরহদ না ইনহে রোকে’

 

    না, না, এ কোনো বাঙ্গালী কবির লাইন নয় আমি জানি, জাভেদ আখতারের শব্দ ও সোনু নিগমের দরদী কণ্ঠ এ গানকে করে রেখেছে কালজয়ী। তবে? তবে কবি নতুন করে কি শোনায় পাঠককে? কবি শোনায়-

 

‘ইচ্ছেগুলি যখন ডানা মেলে দেয়,

দিগন্ত খুঁজতে বেরোয় হারিয়ে যাওয়া নদী।’

 


কবি বলে ওঠে,

‘স্বপ্নই তো!

ভাগ্যিস,

স্বপ্নে কোন কাঁটাতার নেই।’

 

আর পাঠক হারিয়ে যায় কবির সেই রচিত স্বপ্নেগানটি ধীরে ধীরে বেজে ওঠে ব্যাকগ্রাউন্ড জুড়েকবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য ঠিক এভাবেই তাঁর কবিতার হাত ধরে নিয়ে যায় গানের মেহফিলে

 

হামসাফার ও সংগীরা’ বইটি শুরু হয় হামসাফার সিরিজের ১৫টি কবিতা দিয়ে প্রতিটি কবিতার মোড়কে লুকিয়ে রয়েছে এক বহুল প্রচলিত ভালোলাগা গানের কলি তার নিজস্ব সৌরভেএবং এতে কবিতার রস বেড়ে গেছে কয়েকগুণ

 

যেমন, ‘ম্যে শায়ের তো নেহি...’ কবিতায় কবি লিখছেন,

 

‘কুয়াশা ঘেরা জালুকবাড়ি নিয়ন

আলোয় কৃষ্ণচূড়ার পান্ডুর রূপ...

আমাকে কবি করে তোলে।’

 

অথবা, ‘গম কা খাজানা তেরা ভি হ্যয়, মেরা ভি’ গানের কলিটির রেশ জড়িয়ে কবি বলে ওঠে,

 

‘তোমাকে লিখছি জীবনভর,

প্রান্তরে, দিগন্তে, আকাশে

থেমে থাকা নীলিমায়,

চোখের সমুদ্রে।’

 

তবে এই শুধু ১৫ কবিতার বই নয়, বইটির ৬৮টি পাতা জুড়ে হামসাফারের সঙ্গী হয়ে রয়েছে আরো কবিতাকবিতারা শুনিয়ে যায় রাগ, অভিমান, ভালোলাগার মোড়কে এ যুগে সামাজিক চিত্রকথা

 

কখনো কবি বলে ওঠে দেশভাগ বা ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা –

 

‘এমনি এক অন্ধকার রাতে হঠাৎ

চিঠি আসেবন্ধ খামে, স্বপ্নের মতন

 

বয়ানে একমাত্র অক্ষরটি শুধু-D

 

কখনো বাংলা ভাষা ও তার যাবতীয় সংগ্রাম –

 

‘নিজের বুকে মাথা রেখে

শুনে নিতে চাই

অক্ষরময় বেজে চলা

মায়ের ভাষার জীবনমুখী গান

 

তবে এই বইয়ের পাতায় শুধু দুঃখ ও না পাওয়া দিনলিপি নয়, রয়েছে আমাদের পরিচিত কাছের মানুষেরাকখনো বাবা এসে দাঁড়ায় বাড়ির সদর দরজায়-

 

‘দূরে পায়ের শব্দ জেনে যাই

তুমি ঘরে ফিরেছো নির্বিঘ্নে

 

কখনো ঠাকুরমা জমায় তাঁর কচিকাঁচার আসর-

 

‘ঠাম্মি বলতেন,

প্রেম কাছে এলে নাকি

চারিদিকে ভাসতে থাকে রঙিন প্রজাপতি

 

‘হামসাফার ও সঙ্গীরা’ বইটির পাতায় মিলেমিশে রয়েছে উত্তরপূর্বাঞ্চল, যে ভূমি কবির বেড়ে ওঠার আশ্রয়স্থল, তাঁর প্রথম ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া সাক্ষীতাই এই বইয়ের ছড়িয়ে রয়েছে কবির চারপাশের মুহূর্তকবি তাঁর নারীকে বলে ওঠে,

 

‘তোমার বাড়ির পাশের পাকদন্ডি বেয়ে আরেকটু নিচে নেমে এলে,

পাহাড়ের উপর থেকে

হারুলংফার নদী দেখা যায়

 

কবি তার এপিটাফ লিখে বলেন-

 

‘হাতিমুড়া পাহাড়ে কোন একদিন

তোমার কোলে মাথা রেখে পশ্চিমে ঢলে যাব

 

এটি কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, তাই হয়তো কিছু কিছু জায়গায় গান হালকা বেসুরো ঠেকেহামসাফার সিরিজের কিছু কিছু গানের সাথে কবিতার মেলটি মনে হয় যেন আলগা করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছেকিছু কবিতার কয়েকটি লাইন অন্তমিল, অথচ বাকি না হওয়ায়, একটু পড়তে হোচট লাগেপ্রচ্ছদ তেমন আলাদাভাবে নজর কাড়ে না আশা করছি কবি ভবিষ্যতে আরো যত্নবান হবেন ও আমরা পাঠকেরা আরো চমকৃত হব, তার জন্যে রইল আগাম শুভেচ্ছা

 

এই আসা-যাওয়ার ভিড়ে রেখে যাওয়া দিনলিপির দলিল হলো ‘হামসাফার ও সঙ্গীরা’পাঠক ছুঁয়ে দেখবে ও হারিয়ে যাবে এক গানের কনসার্টে, যে গান জীবনের গান, যে গান ঘোর লাগায়, মায়া বাড়ায়, ভালোবাসতে শেখায়

 

তোমার তো গোটা এক তারাভরা রাত ছিল,

আমার শুধুই জানালার শার্সি ভাঙ্গা বঙ্কিম কাঁচ

ওইটুকু সম্বলও আঁজলা ভরে তোমায় দিয়ে দেব,

তারাভরা আকাশে জ্বলে উঠুক এক ফালি চাঁদ

 

বই         : হামসাফার ও সঙ্গীরা

লেখক      : সঞ্জয় ভট্টাচার্য

প্রকাশকাল   : ২০২০    

প্রকাশক    : বই টার্মিনাস, কলকাতা -৬

প্রচ্ছদ      : দয়াময় বন্দোপাধ্যায়



দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত (09.04.2023)

May 16, 2023

কুয়াশায় ভেজা টাইমলাইন

 আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের রিভিউ :



নীলদীপ চক্রবর্তী :

বাংলা কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, মহাকাব্য বা পুরাণের গল্পগাথার সঙ্গে জড়িয়ে পাড়ি দিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি যুগ। সেইসঙ্গে তাকে যুগ প্রয়োজন ও সামাজিক দায়বদ্ধতা মেনে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নতুন আঙ্গিক, সজ্জা, বিন্যাস ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে চলেছেন একনিষ্ঠ কাব্য-সাধকেরা। উত্তর পূর্বের যে কবিরা বাংলা কবিতাকে আগামী পাঠকের জন্য কঠোর পরিশ্রমে লালিত করে চলেছেন কমলিকা মজুমদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম! ২০১৬র ডিসেম্বরএ প্রকাশিত কমলিকার প্রথম কবিতার বই তিনি নিজে ডাকযোগে পাঠালেন, সেই সঙ্গে পেলাম একটি ছোটখাট কবিতা-খনি!ইতিপূর্বে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ওর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু একটি সংকলনের অভাব আমরা অনুভব করছিলাম। আধুনিক সময়ের এক জাগ্রত ও সুচিমুখ উপস্থাপন কবির বই ‘কুয়াশায় ভেজা টাইমলাইন’ । অত্যন্ত যত্নে, নৈপুন্যে ও সংযমে এক একটি কবিতা দিয়ে তিনি এই সময়ের বিভিন্ন স্তরে আঘাত হেনে গেছেন। ইংরেজি শব্দের সাহসী ব্যবহার তাঁর প্রথা ভাঙার বোহেমিয়ানার প্রকাশ। নিকৃষ্ঠ সমাজনীতি, বিকৃত ধর্মব্যাখ্যা, শোষণ ও নারী এই সব বিষয়ের ওপর তীব্র কশাঘাত করা তাঁর কবিতা কিন্তু সৌন্দর্য স্নিগ্ধতা বা শাশ্বত কাব্য থাকার অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হয়নি। ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় কমলিকার মতো প্রতিবাদী কলম অনলস ভাবে এক প্রকৃত কবির দায়ভার বয়ে চলেছে, ‘কুয়াশায় ভেজা টাইমলাইন’, পড়া শেষে, স্তব্ধ পাঠককে এই ভাবেই ভাবাবে!
বরাবরের মতো ভিকি পাবলিশার্স এর মুদ্রণের প্রশংসা না করে পারা যায় না। বইটির শুরুতে লেখকের নিজস্ব কথা, প্রাককথন বা ভূমিকা থাকলে অসংগত হত না। কমলিকা আরো লিখুন, আপনার কবিতা-অস্ত্র ক্রমশ ধারালো হোক!


উইদ লাভ, কমলিকা

আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের রিভিউ :



বাসব রায় :

কতই-বা বয়স তখন, ১৯-২০ হতে পারে। ‘ফুলচোর’ পড়ছি আর ভোরে, চুপে, উঠে জানলার পাশে দাঁড়াচ্ছি। জানলার পাশে বকুলগাছ, বালিকা ফুল কুড়োচ্ছে। নাম কী সেই বালিকার? কমলিকা? হবে-বা, মনে নেই, আজ আর। তখন আমি ‘ফুলচোর’ই পড়েছি, এটা পড়িনি...
‘আমি ঝরাই বকুল
তোমায় ছোঁয়ার তালে
ওই মায়াচ্ছন্ন করতলে।’
বালিকা বকুল কুড়োচ্ছে আর আমি হয়ে উঠেছি বকুলগাছ। এভাবে বালিকা স্পর্শ করে আমাকে, যে স্পর্শে পবিত্র আঁচড়। আর তুমি স্পর্শ করবে, ছুঁয়ে থাকবে বলেই আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব বকুলগাছ হয়ে। এবার উলটো করে পড়ি...
‘শুধু তোমায় ছোঁব বলে
সারাজীবন বকুলগাছ হওয়া যায়।’
ওই বালিকা মনে থেকে গেল। কিংবা বালিকার মনে আমি। তারপর একদিন, যখন তার বয়ঃসন্ধি, বলে, সে, অস্ফুটে...
‘সদ্য বয়ঃসন্ধি প্রেম ঠোঁটে
লেগে থাকা ঘামবিন্দুগুলো
শুষে নিতে পারলে জানবে
সেরে যায় মুখের সব ক্ষত’
এই উচ্চারণ শুধু নারীই করতে পারে। প্রেমের ক্ষেত্রে হৃদয়-উপুড় কবে কোন ছেলে করেছে!
মেয়েরা জানে, অনেক কিছু জানে। যেমন কবিতা পাঠরত কোনো ছেলেকে দেখলে তারা বলতে পারে...
‘প্রেমিকের দুচোখ আটকে আছে কোন কবিতায়
তা জানতে আড়চোখের প্রয়োজন পড়ে না।’
বালিকা কি ভাবে তার, প্রাক্তন, প্রেমিকের কথা?
‘যে বাসরের সোহাগ-মুহূর্ত ভুলে আমার কথা ভাবে
কাঁপা হাতে সিঁদুর ছোঁয় নাক, প্রেমের শুভস্বাক্ষর’
প্রেম ভেঙে যায়, প্রেম জন্ম লয়। নতুনভাবে, মনে-বোধে-চেতনায়। সেইসব রাত নিকশ কালো, সেসব রাতে একেবারে ঘুম আসে না, কেননা ‘মাথার ভিতর এক বোধ জন্ম লয়’...
‘কিছু কিছু রাতে ঘুমোতে নেই
ছোটবেলার হারমোনিয়াম খুলে
প্রতিটা রিড চেপে দেখতে হয়
কতটা ঘুণ ধরল ইচ্ছায়।’
একটি একটি করে দিন যায় আর আমাদের সুপ্ত ইচ্ছেরা মরতে থাকে, ক্রমে। ইচ্ছেয় ঘুণ ধরে। যেমন অনেক কষ্ট করে এই ইচ্ছে সংবরণ করতে হয়...
‘আষাঢ়ের পড়ন্ত বিকেলবেলায়
অনেকদিন পর বাবাকে দেখলাম
সাদা মেঘ চড়ে ভেসে যাচ্ছেন।
মনে হল ডাকি...’
কিন্তু ওই অপরূপকে ডাকা যায় না, শুধু চোখ ভরে দেখতে হয়, প্রকৃতার্থে দেখতেও নয়, অনুভব করতে হয়, আর তাই...
‘কিছু কিছু মেঘেদের ডাকতে নেই
কাছে এলেই ভরা বান, অকাল শ্রাবণ।’
শুরু হয়েছিল আষাঢ় দিয়ে শেষ হল শ্রাবণে এসে। কেন? বাবার কথা মনে পড়লেই চোখ ভিজে যায় বৃষ্টির জলে...
‘বাবাকে নিয়ে ভাবলেই
ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে
অক্ষর নেমে আসে খাতায়,
অক্ষর ভালোবাসায় ভিজে
মুখ বন্ধ করে থাকে চেয়ে।’
প্রেমিকের কথা বলেছি, বাবাকেও তো ডাকলাম, আচ্ছা ডাকলাম না। কিন্তু মা? মায়ের কথা বলি তাহলে...
‘যে শুধু আমায় আলো দেখা বলে
স্বেচ্ছায় পেটে ছুঁইয়েছে নৃসিংহের ধাতব নখ’
মায়েরা ঠিক এরকম... আমার মা, তোমার মা, আমাদের সবার মা।
‘রান্নাঘরের গরম ভাতগন্ধে
ভেসে আসে মায়ের গান।’
আর তাই...
‘জীবনখেলায় বুঝেছি
মাকে ভালোবাসা যতটা সহজ
অনুকরণ ততটা নয়।’
(উদ্ধৃত কবিতাংশ কমলিকা মজুমদারের কবিতাবই ‘উইদ লাভ, কমলিকা’ থেকে নেওয়া)


দেবলীনা সেনগুপ্ত :

ভালোবাসা-বড়ো রহস্যময় এক অনুভূতি৷ আকাশের আলো হয়ে ছুঁয়ে যায় আমাদের জীবন ও জীবনচর্যা৷ আবার সেই ভালোবাসাকেই কখনও ন্যাপথালিন দিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয় পুরনো ট্রাঙ্কের কোণে৷বেড সুইচ নিবে যাওয়ার পর খোলা জানালার মরশুমি হাওয়া কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে যায় সেই ভালোবাসার ফুলবাহারি কথা৷ ব্যালকনির টেরাকোটার টব উপচে পড়ে ভালোবাসা ভরিয়ে দেয় অন্তরের নিকোনো উঠোন৷ এভাবেই বুকের ভেতর, মনের ভেতর বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে --- আর কমলিকা, কবি কমলিকা মজুমদার বলে ওঠেন, "উইদ লাভ, কমলিকা"৷

কবি কমলিকা মজুমদারের সাম্প্রতিকতম কবিতা পুস্তিকা ৷ পাতায় পাতায় কবি ভালোবাসা এঁকেছেন৷ অন্য ভাবনায়, অনন্য ভাষায়৷
সুন্দর প্রচ্ছদ, সুন্দর ছাপা৷
" উইদ মাচ লাভ টু ইউ , কমলিকা---- "


 নীলদীপ চক্রবর্তী :

পরিচিত ফর্ম ভেঙে নতুন অংক ও সমীকরণ তুলে ধরা সচেতন কবির প্রাথমিক লক্ষণ । তায় কবি যদি আবার একজন প্রথম সারির ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকেন ! আবার তিনি এক দুর্দান্ত তরুণীও বটে । তাছাড়া বইয়ের শিরোনাম কোন প্রেমের চিঠির অন্তিম সম্ভাষণ মনে করিয়ে পুলক এবং পড়বার লোভ জাগায় । সুতরং এমন কাব্যের বই হাতে এলে ঝটিতি তুলে নিতে হয়, গোগ্রাসে পরে ফেলতে হয় । আমিও তাই করলাম । এবং আবিষ্কার করা গেল এক নতুন কমলিকাকে, যার হৃদয়ের বিভিন্ন কোনে সযত্নে রক্ষিত সকলের প্রতি ভালোবাসার নীরব অর্ঘটুকু । মা, প্রেম, প্রাক্তন ও শহর এই চারটি দিয়ে পাই চিত্রের বৃত্তংশর মতো বইটিকে সাজিয়েছেন পেশায় এঞ্জিনিয়ার ও গণিতবিলাসী কবি কমলিকা । কমলিকার লেখালেখি আমরা যারা প্রথম থেকেই পড়ছি, তারা মোটামুটি কবির নাম না দেখেই এটি কমলের কবিতা বলে বুঝতে বা ধারণা করতে পারতাম। কিন্তু "উইদ লাভ কমলিকা" নামের ছোট্ট বইটি সেসব ফর্মের বাইরে গিয়ে কবির অন্দরমহলের কুঠুরিতে ডুব মেরেছে । যেহেতু কলেবরে এই পুস্তক নিমন্ত্রনবাড়ির 'স্টার্টর', সেজন্যে লাইন ধরে কোন কবিতা এখানে ব্যাখ্যা করবো না । শুধু এটুকু জানাবো কবি যেমন প্রেমার্তির কথা লিপিবদ্ধ করেন, 'আজ বৃষ্টি হলে একবার বাইরে এসো/দুহাতে জল মেখো শরীরে/বলতে ভুল না/আমি চিনেছি../', ঠিক অন্য ভাবে তিনি ছিন্নমূলের কান্নাকে কবিতার ভাষা দেন, 'এদেশ ও ওদেশের মাঝে/আরেক কাঁটাতারের দেশে/ঝুলে থাকতে থাকতে/নথিপত্ররাও কেমন যেন/ফ্যাকাশে দেখায় আজকাল'...এসবের মতো তীক্ষ্ণ পংক্তি ! বাকিটা পাঠক পড়ুন বই সংগ্রহ করে ! আর দেখুন কিভাবে কবি তার মানুষ হবার দায়বদ্ধতা পালন করেন নিজস্ব সৃষ্টি দিয়ে ! নবীনা কবির লেখালেখি ওর বয়েসের আগেই আরো প্রবীণা ও ক্ষুরধার হয়ে উঠুক । শুভেচ্ছা.... নীলদীপ চক্রবর্তী ।

March 05, 2023

প্রবুদ্ধদাকে যেমন দেখেছি


সম্ভবত ২০১২
। সবে ঈশানকোণের কবিতার স্বাদ নেওয়া শুরু করেছি আর বিস্মিত হচ্ছি। এমন সময় হাতে এলো এক ক্ষুদ্র কবিতা :

‘বাবা, বেগবান অশ্ব  

মা, উদ্ভট সংসারের ভারবাহী গাধা

আমি খচ্চর, বাংলা কবিতা লিখি।’

        এই তিন লাইন আমাকে এনে দিয়েছিলো বিস্ময়। এভাবে কেন কোনদিন ভাবিনি আমি? ইচ্ছে হলো, মানুষটাকে জানার যে নিজেকে অকপটে 'খচ্চর' বলে ঘোষণা করতে পারে। কবির নামটাও কবিতাটির মতই বড় অন্যরকম, একবার শুনলে মনে থাকতে বাধ্য – প্রবুদ্ধসুন্দর কর। এর পর কিছুদিন কাটলো আমার প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতার খোঁজে। যত পড়ছি তত আরও মুগ্ধতা বাড়ছে, রীতিমতো ভক্ত হয়ে পড়েছি  ওই কাব্য কথার। এবং এই ভালোলাগা এখনও একই ভাবে আঘাত করে, যতবার প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতার বই হাতে তুলি, এমনই শব্দের জাদু।


        তখন কবিমহলে আমার পরিচিতি হাতে গোনা কয়েকজন। কিন্তু তাঁদের সবাইকে বলেছিলাম এই কবিকে বড় দেখতে ইচ্ছে হয়, কী করে উনি এমন কথা লিখে ফেলেন বড় জানতে ইচ্ছে হয়। এবং আমার সৌভাগ্য যে একদিন এক পরিচিতের মাধ্যমে আমি ফোনে কথা বলে ফেললাম, ছুঁয়ে ফেললাম কবিকে। মনে আছে প্রথম দিন ফোনেই ওনাকে বলেছিলাম 'আমি আপনার লেখা পড়ে আপনার সাথে কথা না-বলে থাকতে পারলাম না।' তিনি জোরে হেসে উঠেছিলেন। সেই আমাদের পরিচিতি, তার পর ১০ বছরে প্রবুদ্ধদা কখন যে এত কাছের মানুষ হয়ে গেলেন, জানি না।


        প্রবুদ্ধদার কবিতার সম্পর্কে জ্ঞান ও তার ব্যাপ্তি যে কি সুবিশাল ও সুগভীর, কথা না বললে ভাবা যায় না। কতদিন যে কত নামী-অনামী-বেনামী কবির কবিতা মেসেঞ্জারে পড়িয়েছেন, তার হিসেব নেই। বইয়ের নাম পাঠিয়ে বলেছেন, কিনে ফেলো। প্রবুদ্ধদার কাছে ছিল এক ঈর্ষণীয় মেমোরি পাওয়ার। বহু পুরোনো কথা মনে রাখতে পারতেন।গত বছর দারুহরিদ্রার ব্লগে তখন নিয়মিত তাঁর ধারাবাহিক আত্মজীবনী গদ্য ‘নীল উপত্যকার রাখাল’ প্রকাশ হচ্ছে। প্রকাশ হলে উনি লিংক পাঠিয়ে দিতেন। মনে আছে কিছু কিছু অংশ (খুব সম্ভব একটি মেলার বিবরণ)  পড়ে তাঁকে বললাম, 'আপনি এতো ডিটেল মনে রেখেছেন? সত্যি মিথ্যে মিশিয়ে উপাদেয় করছেন, তাই না?' তিনি হাসলেন, বললেন, 'তোমার সাথে প্রথম দেখা হওয়া অনেক বছর হয়ে গেছে, আমি আজ ও বলতে পারবো আমরা সেদিন ঠিক কি কথা বলেছিলাম।' এরপর মনে হলো সত্যি তো এই কথাই তো হয়েছিল। বললেন- 'কি?পরীক্ষায় পাশ তো?'


        আরেকটা কথা মনে পড়ে গেলো, কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের গানের প্রতি ভালোবাসা। প্রচুর ভালো ভালো গান সোসাল মিডিয়ায় শেয়ার করতেন। তিনি প্রথম আমায় জানিয়েছিলেন যে কমলিকা দিয়েও গান আছে। এর আগে আমি অখিলবন্ধু ঘোষের ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ গানটা শুনিনি। তাঁকে এই কথা বলার পর তিনি যেখানে যত রকম এই গানটির ভার্সন পেতেন, আমাকে ট্যাগ করে দিতেন। বলতেন যখন শোনোনি, বেশি শুনিয়ে ব্যালান্স করে দিচ্ছি- তিনি ছিলেন ঠিক এমনই উইটি।


        আসলে যখন এমন প্রাণোজ্জ্বল মানুষ হুট করে চলে যায়, কেমন যেন মন খারাপের মেঘ ঘিরে ধরে। এমন স্মৃতিকণাগুলোই তখন হয়ে ওঠে মেঘলা দিনের সঙ্গী। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই জানি প্রবুদ্ধদা অসুস্থ, কারণ সেটা তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম। অথচ তাঁর কথায়, কর্মে বা কবিতায় সে ছাপ পরেনি কখনও। তাই মন বিশ্বাস করতো তিনি ঠিক আছেন, যখন হায়দ্রাবাদ গেলেন তখন ও মন বলত সব ঠিক হয়ে যাবে।


       স্মৃতিকথা লিখতে বসে কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর নিয়ে না-লিখে এতক্ষণ শুধু প্রবুদ্ধদা নিয়েই লিখে গেছি। আসলে, এমন শক্তিশালী যাঁর লেখন-ভঙ্গিমা, তাঁর লেখা নিয়ে কিছু লেখার দরকার পড়ে না। প্রবুদ্ধদার কবিতার বই শুধু হাতে তুলে নিতে হয় আর পাঠ করতে হয়,  নিজে নিজে, একান্তে। এবং প্রতিবার শব্দগুলো গিয়ে আঘাত করে গ্রে-সেলগুলোতে, এমনই তার জাদু। কবিতা নিজে নিজেই মুখস্ত হয়ে যায়, বলা ভালো আত্মস্থ হয়ে যায়।


           এমন স্মার্ট, সময়োচিত ও দৃঢ় শব্দ প্রয়োগ খুব কম কবি আয়ত্তে আনতে পারেন আর তাঁর ক্ষেত্রে ওইটাই ন্যাচারাল। তাই তো পাঠক নিজে থেকেই খুঁজে নিয়েছে প্রবুদ্ধদার কবিতা। তাই হারানোর পর এতো হাহাকার। তাই, কবি প্রবুদ্ধসুন্দর থেকে যাবেন এই শব্দগুলোর মধ্যে আমাদের, অন্তরের গহীনে। বইয়ের পাতা ছুঁলেই মন বলে উঠবে বারবার 

‘পৃথিবীতে এত ছল

যে কোনো ছুতোয়, প্রবুদ্ধসুন্দর চলে এসো।’  


গুয়াহাটির 'একা এবং কয়েকজন' পত্রিকায় প্রকাশিত (৪৩ বর্ষ, কবিতা সংখ্যা, নভেম্বর ২০২২)

January 22, 2023

প্রেমে-অপ্রেমে (Season 2)

@কমলিকা 
 ১)

আমাদের ড্রিমক্যাচার ভালোবাসারা

নতুন টোটেম খুঁজে শহুরে বারান্দায়,

রেশমি সুতার গিঁট গুণে বানায়

প্রেম আটকের এক আশ্চর্য ওয়েব।

 

সাদা কালো পাখা ও রঙিন বিডস

হাওয়ার দোলায় উড়ে যেতে চায়

উইন্ডোফ্রেমে দেখা সবুজ বাগানে।

 

স্বপ্নের মানে খুঁজতে নেই গুগলে, শুধু

দেখে যেতে হয়, জেগে ওঠার আগে।

 

২)

আমাদের এক্স ওয়াই ভালোবাসারা

অংক ভুলের ভয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসে,

গাইডবুক এর উত্তর আগেই দেখে

সাজায় সাপ-সিঁড়ির সকল সংকেত।

 

অ্যালজেবরা খাতায় যাবতীয় সূত্রেরা

শহরের ইলেকট্রিক পোলে চায় ছুঁতে,

আরেক অর্ধেক অংকের পাখি মন।

 

লাভ ব্যালাডের ছেঁড়া উৎসর্গ পাতা শুধু

উত্তর না মেলার খুশিতে লেখে নতুন গান।


১৪.০২.২০২২ -এ দৈনিক বজ্রকন্ঠ' ওয়েবজিনে প্রকাশিত (আগরতলা, ত্রিপুরা)। 


More to see...