May 20, 2023

হামসফর ও সঙ্গীরা

 ‘পঞ্ছি নদীয়া পবনকে ঝোঁকে, কোই সরহদ না ইনহে রোকে’

 

    না, না, এ কোনো বাঙ্গালী কবির লাইন নয় আমি জানি, জাভেদ আখতারের শব্দ ও সোনু নিগমের দরদী কণ্ঠ এ গানকে করে রেখেছে কালজয়ী। তবে? তবে কবি নতুন করে কি শোনায় পাঠককে? কবি শোনায়-

 

‘ইচ্ছেগুলি যখন ডানা মেলে দেয়,

দিগন্ত খুঁজতে বেরোয় হারিয়ে যাওয়া নদী।’

 


কবি বলে ওঠে,

‘স্বপ্নই তো!

ভাগ্যিস,

স্বপ্নে কোন কাঁটাতার নেই।’

 

আর পাঠক হারিয়ে যায় কবির সেই রচিত স্বপ্নেগানটি ধীরে ধীরে বেজে ওঠে ব্যাকগ্রাউন্ড জুড়েকবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য ঠিক এভাবেই তাঁর কবিতার হাত ধরে নিয়ে যায় গানের মেহফিলে

 

হামসাফার ও সংগীরা’ বইটি শুরু হয় হামসাফার সিরিজের ১৫টি কবিতা দিয়ে প্রতিটি কবিতার মোড়কে লুকিয়ে রয়েছে এক বহুল প্রচলিত ভালোলাগা গানের কলি তার নিজস্ব সৌরভেএবং এতে কবিতার রস বেড়ে গেছে কয়েকগুণ

 

যেমন, ‘ম্যে শায়ের তো নেহি...’ কবিতায় কবি লিখছেন,

 

‘কুয়াশা ঘেরা জালুকবাড়ি নিয়ন

আলোয় কৃষ্ণচূড়ার পান্ডুর রূপ...

আমাকে কবি করে তোলে।’

 

অথবা, ‘গম কা খাজানা তেরা ভি হ্যয়, মেরা ভি’ গানের কলিটির রেশ জড়িয়ে কবি বলে ওঠে,

 

‘তোমাকে লিখছি জীবনভর,

প্রান্তরে, দিগন্তে, আকাশে

থেমে থাকা নীলিমায়,

চোখের সমুদ্রে।’

 

তবে এই শুধু ১৫ কবিতার বই নয়, বইটির ৬৮টি পাতা জুড়ে হামসাফারের সঙ্গী হয়ে রয়েছে আরো কবিতাকবিতারা শুনিয়ে যায় রাগ, অভিমান, ভালোলাগার মোড়কে এ যুগে সামাজিক চিত্রকথা

 

কখনো কবি বলে ওঠে দেশভাগ বা ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা –

 

‘এমনি এক অন্ধকার রাতে হঠাৎ

চিঠি আসেবন্ধ খামে, স্বপ্নের মতন

 

বয়ানে একমাত্র অক্ষরটি শুধু-D

 

কখনো বাংলা ভাষা ও তার যাবতীয় সংগ্রাম –

 

‘নিজের বুকে মাথা রেখে

শুনে নিতে চাই

অক্ষরময় বেজে চলা

মায়ের ভাষার জীবনমুখী গান

 

তবে এই বইয়ের পাতায় শুধু দুঃখ ও না পাওয়া দিনলিপি নয়, রয়েছে আমাদের পরিচিত কাছের মানুষেরাকখনো বাবা এসে দাঁড়ায় বাড়ির সদর দরজায়-

 

‘দূরে পায়ের শব্দ জেনে যাই

তুমি ঘরে ফিরেছো নির্বিঘ্নে

 

কখনো ঠাকুরমা জমায় তাঁর কচিকাঁচার আসর-

 

‘ঠাম্মি বলতেন,

প্রেম কাছে এলে নাকি

চারিদিকে ভাসতে থাকে রঙিন প্রজাপতি

 

‘হামসাফার ও সঙ্গীরা’ বইটির পাতায় মিলেমিশে রয়েছে উত্তরপূর্বাঞ্চল, যে ভূমি কবির বেড়ে ওঠার আশ্রয়স্থল, তাঁর প্রথম ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া সাক্ষীতাই এই বইয়ের ছড়িয়ে রয়েছে কবির চারপাশের মুহূর্তকবি তাঁর নারীকে বলে ওঠে,

 

‘তোমার বাড়ির পাশের পাকদন্ডি বেয়ে আরেকটু নিচে নেমে এলে,

পাহাড়ের উপর থেকে

হারুলংফার নদী দেখা যায়

 

কবি তার এপিটাফ লিখে বলেন-

 

‘হাতিমুড়া পাহাড়ে কোন একদিন

তোমার কোলে মাথা রেখে পশ্চিমে ঢলে যাব

 

এটি কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, তাই হয়তো কিছু কিছু জায়গায় গান হালকা বেসুরো ঠেকেহামসাফার সিরিজের কিছু কিছু গানের সাথে কবিতার মেলটি মনে হয় যেন আলগা করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছেকিছু কবিতার কয়েকটি লাইন অন্তমিল, অথচ বাকি না হওয়ায়, একটু পড়তে হোচট লাগেপ্রচ্ছদ তেমন আলাদাভাবে নজর কাড়ে না আশা করছি কবি ভবিষ্যতে আরো যত্নবান হবেন ও আমরা পাঠকেরা আরো চমকৃত হব, তার জন্যে রইল আগাম শুভেচ্ছা

 

এই আসা-যাওয়ার ভিড়ে রেখে যাওয়া দিনলিপির দলিল হলো ‘হামসাফার ও সঙ্গীরা’পাঠক ছুঁয়ে দেখবে ও হারিয়ে যাবে এক গানের কনসার্টে, যে গান জীবনের গান, যে গান ঘোর লাগায়, মায়া বাড়ায়, ভালোবাসতে শেখায়

 

তোমার তো গোটা এক তারাভরা রাত ছিল,

আমার শুধুই জানালার শার্সি ভাঙ্গা বঙ্কিম কাঁচ

ওইটুকু সম্বলও আঁজলা ভরে তোমায় দিয়ে দেব,

তারাভরা আকাশে জ্বলে উঠুক এক ফালি চাঁদ

 

বই         : হামসাফার ও সঙ্গীরা

লেখক      : সঞ্জয় ভট্টাচার্য

প্রকাশকাল   : ২০২০    

প্রকাশক    : বই টার্মিনাস, কলকাতা -৬

প্রচ্ছদ      : দয়াময় বন্দোপাধ্যায়



দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত (09.04.2023)

2 comments:

  1. সুন্দর মূল্যায়ন। কবিকেও শুভেচ্ছা, এরকম আরও কাব্য উপহার দেবেন, এই আশা রাখি।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ তোমাকে

    ReplyDelete

More to see...