May 16, 2023

উইদ লাভ, কমলিকা

আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের রিভিউ :



বাসব রায় :

কতই-বা বয়স তখন, ১৯-২০ হতে পারে। ‘ফুলচোর’ পড়ছি আর ভোরে, চুপে, উঠে জানলার পাশে দাঁড়াচ্ছি। জানলার পাশে বকুলগাছ, বালিকা ফুল কুড়োচ্ছে। নাম কী সেই বালিকার? কমলিকা? হবে-বা, মনে নেই, আজ আর। তখন আমি ‘ফুলচোর’ই পড়েছি, এটা পড়িনি...
‘আমি ঝরাই বকুল
তোমায় ছোঁয়ার তালে
ওই মায়াচ্ছন্ন করতলে।’
বালিকা বকুল কুড়োচ্ছে আর আমি হয়ে উঠেছি বকুলগাছ। এভাবে বালিকা স্পর্শ করে আমাকে, যে স্পর্শে পবিত্র আঁচড়। আর তুমি স্পর্শ করবে, ছুঁয়ে থাকবে বলেই আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব বকুলগাছ হয়ে। এবার উলটো করে পড়ি...
‘শুধু তোমায় ছোঁব বলে
সারাজীবন বকুলগাছ হওয়া যায়।’
ওই বালিকা মনে থেকে গেল। কিংবা বালিকার মনে আমি। তারপর একদিন, যখন তার বয়ঃসন্ধি, বলে, সে, অস্ফুটে...
‘সদ্য বয়ঃসন্ধি প্রেম ঠোঁটে
লেগে থাকা ঘামবিন্দুগুলো
শুষে নিতে পারলে জানবে
সেরে যায় মুখের সব ক্ষত’
এই উচ্চারণ শুধু নারীই করতে পারে। প্রেমের ক্ষেত্রে হৃদয়-উপুড় কবে কোন ছেলে করেছে!
মেয়েরা জানে, অনেক কিছু জানে। যেমন কবিতা পাঠরত কোনো ছেলেকে দেখলে তারা বলতে পারে...
‘প্রেমিকের দুচোখ আটকে আছে কোন কবিতায়
তা জানতে আড়চোখের প্রয়োজন পড়ে না।’
বালিকা কি ভাবে তার, প্রাক্তন, প্রেমিকের কথা?
‘যে বাসরের সোহাগ-মুহূর্ত ভুলে আমার কথা ভাবে
কাঁপা হাতে সিঁদুর ছোঁয় নাক, প্রেমের শুভস্বাক্ষর’
প্রেম ভেঙে যায়, প্রেম জন্ম লয়। নতুনভাবে, মনে-বোধে-চেতনায়। সেইসব রাত নিকশ কালো, সেসব রাতে একেবারে ঘুম আসে না, কেননা ‘মাথার ভিতর এক বোধ জন্ম লয়’...
‘কিছু কিছু রাতে ঘুমোতে নেই
ছোটবেলার হারমোনিয়াম খুলে
প্রতিটা রিড চেপে দেখতে হয়
কতটা ঘুণ ধরল ইচ্ছায়।’
একটি একটি করে দিন যায় আর আমাদের সুপ্ত ইচ্ছেরা মরতে থাকে, ক্রমে। ইচ্ছেয় ঘুণ ধরে। যেমন অনেক কষ্ট করে এই ইচ্ছে সংবরণ করতে হয়...
‘আষাঢ়ের পড়ন্ত বিকেলবেলায়
অনেকদিন পর বাবাকে দেখলাম
সাদা মেঘ চড়ে ভেসে যাচ্ছেন।
মনে হল ডাকি...’
কিন্তু ওই অপরূপকে ডাকা যায় না, শুধু চোখ ভরে দেখতে হয়, প্রকৃতার্থে দেখতেও নয়, অনুভব করতে হয়, আর তাই...
‘কিছু কিছু মেঘেদের ডাকতে নেই
কাছে এলেই ভরা বান, অকাল শ্রাবণ।’
শুরু হয়েছিল আষাঢ় দিয়ে শেষ হল শ্রাবণে এসে। কেন? বাবার কথা মনে পড়লেই চোখ ভিজে যায় বৃষ্টির জলে...
‘বাবাকে নিয়ে ভাবলেই
ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে
অক্ষর নেমে আসে খাতায়,
অক্ষর ভালোবাসায় ভিজে
মুখ বন্ধ করে থাকে চেয়ে।’
প্রেমিকের কথা বলেছি, বাবাকেও তো ডাকলাম, আচ্ছা ডাকলাম না। কিন্তু মা? মায়ের কথা বলি তাহলে...
‘যে শুধু আমায় আলো দেখা বলে
স্বেচ্ছায় পেটে ছুঁইয়েছে নৃসিংহের ধাতব নখ’
মায়েরা ঠিক এরকম... আমার মা, তোমার মা, আমাদের সবার মা।
‘রান্নাঘরের গরম ভাতগন্ধে
ভেসে আসে মায়ের গান।’
আর তাই...
‘জীবনখেলায় বুঝেছি
মাকে ভালোবাসা যতটা সহজ
অনুকরণ ততটা নয়।’
(উদ্ধৃত কবিতাংশ কমলিকা মজুমদারের কবিতাবই ‘উইদ লাভ, কমলিকা’ থেকে নেওয়া)


দেবলীনা সেনগুপ্ত :

ভালোবাসা-বড়ো রহস্যময় এক অনুভূতি৷ আকাশের আলো হয়ে ছুঁয়ে যায় আমাদের জীবন ও জীবনচর্যা৷ আবার সেই ভালোবাসাকেই কখনও ন্যাপথালিন দিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয় পুরনো ট্রাঙ্কের কোণে৷বেড সুইচ নিবে যাওয়ার পর খোলা জানালার মরশুমি হাওয়া কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে যায় সেই ভালোবাসার ফুলবাহারি কথা৷ ব্যালকনির টেরাকোটার টব উপচে পড়ে ভালোবাসা ভরিয়ে দেয় অন্তরের নিকোনো উঠোন৷ এভাবেই বুকের ভেতর, মনের ভেতর বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে --- আর কমলিকা, কবি কমলিকা মজুমদার বলে ওঠেন, "উইদ লাভ, কমলিকা"৷

কবি কমলিকা মজুমদারের সাম্প্রতিকতম কবিতা পুস্তিকা ৷ পাতায় পাতায় কবি ভালোবাসা এঁকেছেন৷ অন্য ভাবনায়, অনন্য ভাষায়৷
সুন্দর প্রচ্ছদ, সুন্দর ছাপা৷
" উইদ মাচ লাভ টু ইউ , কমলিকা---- "


 নীলদীপ চক্রবর্তী :

পরিচিত ফর্ম ভেঙে নতুন অংক ও সমীকরণ তুলে ধরা সচেতন কবির প্রাথমিক লক্ষণ । তায় কবি যদি আবার একজন প্রথম সারির ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকেন ! আবার তিনি এক দুর্দান্ত তরুণীও বটে । তাছাড়া বইয়ের শিরোনাম কোন প্রেমের চিঠির অন্তিম সম্ভাষণ মনে করিয়ে পুলক এবং পড়বার লোভ জাগায় । সুতরং এমন কাব্যের বই হাতে এলে ঝটিতি তুলে নিতে হয়, গোগ্রাসে পরে ফেলতে হয় । আমিও তাই করলাম । এবং আবিষ্কার করা গেল এক নতুন কমলিকাকে, যার হৃদয়ের বিভিন্ন কোনে সযত্নে রক্ষিত সকলের প্রতি ভালোবাসার নীরব অর্ঘটুকু । মা, প্রেম, প্রাক্তন ও শহর এই চারটি দিয়ে পাই চিত্রের বৃত্তংশর মতো বইটিকে সাজিয়েছেন পেশায় এঞ্জিনিয়ার ও গণিতবিলাসী কবি কমলিকা । কমলিকার লেখালেখি আমরা যারা প্রথম থেকেই পড়ছি, তারা মোটামুটি কবির নাম না দেখেই এটি কমলের কবিতা বলে বুঝতে বা ধারণা করতে পারতাম। কিন্তু "উইদ লাভ কমলিকা" নামের ছোট্ট বইটি সেসব ফর্মের বাইরে গিয়ে কবির অন্দরমহলের কুঠুরিতে ডুব মেরেছে । যেহেতু কলেবরে এই পুস্তক নিমন্ত্রনবাড়ির 'স্টার্টর', সেজন্যে লাইন ধরে কোন কবিতা এখানে ব্যাখ্যা করবো না । শুধু এটুকু জানাবো কবি যেমন প্রেমার্তির কথা লিপিবদ্ধ করেন, 'আজ বৃষ্টি হলে একবার বাইরে এসো/দুহাতে জল মেখো শরীরে/বলতে ভুল না/আমি চিনেছি../', ঠিক অন্য ভাবে তিনি ছিন্নমূলের কান্নাকে কবিতার ভাষা দেন, 'এদেশ ও ওদেশের মাঝে/আরেক কাঁটাতারের দেশে/ঝুলে থাকতে থাকতে/নথিপত্ররাও কেমন যেন/ফ্যাকাশে দেখায় আজকাল'...এসবের মতো তীক্ষ্ণ পংক্তি ! বাকিটা পাঠক পড়ুন বই সংগ্রহ করে ! আর দেখুন কিভাবে কবি তার মানুষ হবার দায়বদ্ধতা পালন করেন নিজস্ব সৃষ্টি দিয়ে ! নবীনা কবির লেখালেখি ওর বয়েসের আগেই আরো প্রবীণা ও ক্ষুরধার হয়ে উঠুক । শুভেচ্ছা.... নীলদীপ চক্রবর্তী ।

No comments:

Post a Comment

More to see...