সম্ভবত ২০১২। সবে ঈশানকোণের কবিতার স্বাদ নেওয়া শুরু করেছি আর বিস্মিত হচ্ছি। এমন সময় হাতে এলো এক ক্ষুদ্র কবিতা :
‘বাবা, বেগবান অশ্ব
মা, উদ্ভট সংসারের ভারবাহী গাধা
আমি খচ্চর, বাংলা কবিতা লিখি।’
এই তিন লাইন আমাকে এনে দিয়েছিলো বিস্ময়। এভাবে কেন কোনদিন ভাবিনি আমি? ইচ্ছে হলো, মানুষটাকে জানার যে নিজেকে অকপটে 'খচ্চর' বলে ঘোষণা করতে পারে। কবির নামটাও কবিতাটির মতই বড় অন্যরকম, একবার শুনলে মনে থাকতে বাধ্য – প্রবুদ্ধসুন্দর কর। এর পর কিছুদিন কাটলো আমার প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতার খোঁজে। যত পড়ছি তত আরও মুগ্ধতা বাড়ছে, রীতিমতো ভক্ত হয়ে পড়েছি ওই কাব্য কথার। এবং এই ভালোলাগা এখনও একই ভাবে আঘাত করে, যতবার প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতার বই হাতে তুলি, এমনই শব্দের জাদু।
তখন কবিমহলে আমার পরিচিতি
হাতে গোনা কয়েকজন। কিন্তু তাঁদের সবাইকে বলেছিলাম এই কবিকে বড় দেখতে ইচ্ছে হয়, কী করে উনি এমন কথা লিখে ফেলেন বড় জানতে ইচ্ছে হয়। এবং আমার সৌভাগ্য যে একদিন এক
পরিচিতের মাধ্যমে আমি ফোনে কথা বলে ফেললাম, ছুঁয়ে ফেললাম কবিকে। মনে আছে প্রথম দিন
ফোনেই ওনাকে বলেছিলাম 'আমি আপনার লেখা পড়ে আপনার সাথে কথা না-বলে থাকতে পারলাম না।' তিনি জোরে হেসে উঠেছিলেন। সেই আমাদের পরিচিতি, তার পর ১০ বছরে প্রবুদ্ধদা কখন যে
এত কাছের মানুষ হয়ে গেলেন, জানি না।
প্রবুদ্ধদার কবিতার সম্পর্কে জ্ঞান ও
তার ব্যাপ্তি যে কি সুবিশাল ও সুগভীর, কথা না বললে ভাবা যায় না। কতদিন যে কত নামী-অনামী-বেনামী
কবির কবিতা মেসেঞ্জারে পড়িয়েছেন, তার হিসেব নেই। বইয়ের নাম পাঠিয়ে বলেছেন, কিনে
ফেলো। প্রবুদ্ধদার কাছে ছিল এক
ঈর্ষণীয় মেমোরি পাওয়ার। বহু পুরোনো কথা মনে রাখতে পারতেন।গত বছর দারুহরিদ্রার ব্লগে
তখন নিয়মিত তাঁর ধারাবাহিক আত্মজীবনী গদ্য ‘নীল উপত্যকার রাখাল’ প্রকাশ হচ্ছে। প্রকাশ
হলে উনি লিংক পাঠিয়ে দিতেন। মনে আছে কিছু কিছু অংশ (খুব সম্ভব একটি মেলার
বিবরণ) পড়ে তাঁকে বললাম, 'আপনি এতো ডিটেল
মনে রেখেছেন? সত্যি মিথ্যে মিশিয়ে উপাদেয় করছেন, তাই না?' তিনি হাসলেন, বললেন, 'তোমার সাথে প্রথম দেখা হওয়া অনেক বছর হয়ে গেছে, আমি আজ ও বলতে পারবো আমরা সেদিন
ঠিক কি কথা বলেছিলাম।' এরপর মনে হলো সত্যি তো এই কথাই তো হয়েছিল। বললেন- 'কি?পরীক্ষায় পাশ তো?'
আরেকটা কথা মনে পড়ে গেলো,
কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের গানের প্রতি ভালোবাসা। প্রচুর ভালো ভালো গান সোসাল
মিডিয়ায় শেয়ার করতেন। তিনি প্রথম আমায় জানিয়েছিলেন যে কমলিকা দিয়েও গান আছে। এর আগে
আমি অখিলবন্ধু ঘোষের ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ গানটা শুনিনি। তাঁকে এই কথা বলার
পর তিনি যেখানে যত রকম এই গানটির ভার্সন পেতেন, আমাকে ট্যাগ করে দিতেন। বলতেন যখন
শোনোনি, বেশি শুনিয়ে ব্যালান্স করে দিচ্ছি- তিনি ছিলেন ঠিক এমনই উইটি।
আসলে যখন এমন প্রাণোজ্জ্বল মানুষ হুট করে চলে
যায়, কেমন যেন মন খারাপের মেঘ ঘিরে ধরে। এমন স্মৃতিকণাগুলোই
তখন হয়ে ওঠে মেঘলা দিনের সঙ্গী। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই জানি প্রবুদ্ধদা অসুস্থ, কারণ সেটা তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম। অথচ তাঁর কথায়, কর্মে বা কবিতায় সে ছাপ পরেনি কখনও। তাই মন বিশ্বাস করতো তিনি ঠিক আছেন, যখন হায়দ্রাবাদ গেলেন তখন ও মন বলত
সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্মৃতিকথা লিখতে বসে কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর নিয়ে
না-লিখে এতক্ষণ শুধু প্রবুদ্ধদা নিয়েই লিখে গেছি। আসলে, এমন শক্তিশালী যাঁর লেখন-ভঙ্গিমা, তাঁর লেখা নিয়ে কিছু লেখার দরকার পড়ে না। প্রবুদ্ধদার কবিতার বই শুধু হাতে
তুলে নিতে হয় আর পাঠ করতে হয়, নিজে নিজে, একান্তে। এবং প্রতিবার শব্দগুলো গিয়ে আঘাত
করে গ্রে-সেলগুলোতে, এমনই তার জাদু। কবিতা নিজে নিজেই মুখস্ত হয়ে যায়, বলা ভালো
আত্মস্থ হয়ে যায়।
এমন স্মার্ট, সময়োচিত ও দৃঢ় শব্দ প্রয়োগ খুব কম কবি আয়ত্তে আনতে পারেন আর তাঁর ক্ষেত্রে
ওইটাই ন্যাচারাল। তাই তো পাঠক নিজে থেকেই খুঁজে নিয়েছে প্রবুদ্ধদার কবিতা। তাই
হারানোর পর এতো হাহাকার। তাই, কবি প্রবুদ্ধসুন্দর থেকে যাবেন এই শব্দগুলোর মধ্যে আমাদের, অন্তরের গহীনে। বইয়ের পাতা ছুঁলেই মন বলে উঠবে
বারবার
‘পৃথিবীতে এত ছল
যে কোনো ছুতোয়, প্রবুদ্ধসুন্দর চলে এসো।’
গুয়াহাটির 'একা এবং কয়েকজন' পত্রিকায় প্রকাশিত (৪৩ বর্ষ, কবিতা সংখ্যা, নভেম্বর ২০২২)