June 05, 2022

জাস্ট ফ্রেন্ডস

@কমলিকা 

            মল্লিকা আর বসন্ত সেই ছোট থেকে বন্ধু, মানে বি.এফ.এফ.আসলে ওদের বন্ধুত্বের সুতো বাঁধা এক জেনারেশন আগে; দু’জনের বাবা অফিস কলিগ, ফলে একে অপরের বাসায় অবাধ যাওয়া আসা।ওরা দু’জনে ছেলে হলে, হরিহর আত্মা শব্দের ডিক্শনারি-তে মানে ওদের নাম লেখা হতো। এক স্কুল, কোচিং, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বন্ধুমহল – তাই বন্ধুত্বটা সময়ের কাঁটা চলা সত্তেও থেকে যায় অটুট।

তবে নিউটনের চতুর্থ, না না, বিরাশি নম্বর সূত্র ধরে যথা সময়ে দু’জনের জীবনেই আসে যৌবন ও অবশ্যই প্রেম। তবে যা ভাবছেন তা কিন্তু নয়, কলেজ লাইফে ডেট বা ক্রাশ তো আসে, কিন্তু অন্যের সাথে।

-   দেখ না সন্তু, রনি আমার মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না তিন ঘণ্টা হলো।

-   এই, তোরা  মেয়েরা এত চিপকু কেন রে মলি? বেচারা তো ঘুমোতেও পারে। দেবে, দেবে, একটু সময় দে। তোর মত মালকে ছেড়ে বাবু যাবে কোথায়?

-   আবার মুখ খারাপ করছিস?বন্ধুকে কেউ মাল বলে?দেবো কাকুকে বলে?আচ্ছা করে কান মুলে দিবে?

-   ইসঃ! এলেন আমার গুরুমাতা রে, তুই স্ল্যাং বলিস না?তুই আগে এমন নালিশকুটি ছিলি না। যত দিন যাচ্ছে, ওই  ন্যাকা ন্যাকা মেয়েগুলোর মত হয়ে যাচ্ছিস, ডিসগাস্টিং।

-   সন্তু, ভালো হবে না কিন্তু। আচ্ছা, তুই কি অদ্রিজাকেও এমন খিস্তি দিয়ে কথা বলিস?

-   ধ্যাৎ, কী যে বলিস? তুই আর অদ্রিজা এক হলো?এতো চিনি ঢেলে কথা বলি, তাও পাত্তা দেয় না মাইরি!কী করি বলতো?

-   সে দেয় না দেয় না, ছাড় তো। যে মেয়ে তোকে পাত্তা দেয় না, সে মস্ত বড় বোকা।

-   থাক, সান্তনা পুরস্কার চাই না। আমি জানিরে মলি, এ যুগে দেখাটাই আসল।

-   আবার বাজে কথা বলে ছেলেটা, মোটেই তেমন কিছু নয়। এই যে আমি তোকে এত ভালবাসি, এটা কি তোর রূপ দেখে না তুই এত ভালো বলে? সবাই এক হয় না রে, একদিন ঠিক দেখবি এমন একজনকে খুঁজে পাবি তুই।

-   হুমম, সেই আশায় তো আছি, গান গেয়ে বলবো – আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভালোবাসায় ভোলাবো... 

-   ওরে আমার রবীন্দ্রনাথের নাতি, মরে যাই, মরে যাই। এই যা:, তোর সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গিয়েছি যে রনির বাচ্চাটা এখনও রিপ্লাই দেয় নি। ও সিওর  নীলাঞ্জনার সাথে এখন প্রেম প্রেম খেলছে। আমার ক’দিন ধরেই মনে হচ্ছে, ডাল মে কালা হে!

-   তো তুই ঐ ক্যাবলাটাকে ধরে রেখেছিস কেন এতো যদি সন্দেহ?

-   তুই যেমন অদ্রিজাকে ধরে ঝুলে আছিস।

-   আবার? যা, আমি খেলবো না। ফোন কাটলাম, তুই অপেক্ষা কর।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে সন্তু মানে বসন্ত দেখতে একটু খারাপের দিকে। মুখে ব্রণ, পিচকালো, দাঁতগুলো এবড়ো খেবড়ো ও সাইজটাও ট্রিপল এক্স এল। এই চেহারার জন্যেই ও একটু লো কনফিডেন্সে ভোগে। যদিও সেই ভয় মনের মধ্যেই আটকে রেখে দেয়। বাইরে সন্তু হেব্বি স্মার্ট, ব্রাইট, ফ্রেন্ডলি। শুধু মলি জানে ওর মনের এই উইক-লিংক।

মল্লিকা বহুবার বলেছে এই সব বাজে চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু কোথাও মনের আর্কাইভে এই ইনসিকিউরীটিগুলো থেকেই যায়। আর খোঁচা পেলেই সে আকাশে মেঘ জমে, আর বৃষ্টি পড়ে।

-   জানিস মলি, অদ্রিজা বলেছে ওর আর সৌগতের মধ্যে এফেয়ার চলছে।

-   আচ্ছা, তাই আমাকে জরুরী তলব, আমি ভাবি এই কলেজ ক্যাম্পাসে আসার পর তো দেখাই পাওয়া যায় না। ভাগ্গীস্, ক্লাস একসাথে ছিল। না হলে প্রভুর দর্শনই পেতাম না।

-   মোটেই তা নয়। যদি রোজ রোজ আমাদের দু’জনকে এমন কলেজের পর গল্প করতে দেখে, এরা আমাদের গল্প বানিয়ে ওয়ালে সেঁটে দেবে। তুই তো জানিস রেগিং পিরিওডে আমার বোঝাতে বোঝাতে জান গেছে যে তুই ও আমি স্রেফ বন্ধু, আর কিছু না। লাস্টে বললাম বোনের মত, রাখি পরায়, তারপর শান্তি। বলে আমার মত আলকাতরা তোকে কী করে পটালো, ডেমনস্ট্রেট করতে!

-   হা হা হা, বেচারা, এবার রাখি পরিয়ে দেবো না কি তবে?

-   ফালতু মটকা গরম করিস না। আমার এখন দেবদাসের মত অবস্থা, মদ খেতে ইচ্ছে করছে মাইরি।

-   খাবি? আমাকে খাওয়াবি? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হয় কেমন লাগে?খাওয়া না প্লিজ সন্তু, বল খাওয়াবি, বল ...

-   এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম বাবা?চুপ, ফালতু কথা না। খাওয়াই আর জেঠু আমাকে বঁটিদা দিয়ে পিস পিস করে কাটুক।

-   জানলে তো কাটবে, খাওয়া না, প্লিজ ...

-   যা তো, নিজের হোস্টেলে যা, ভাগ ...

-   এই সন্তু, তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

-   কিসের জন্যে? অদ্রিজা? ধুর! ও তো বুঝলই না কী হারালো?তাই না রে বল?

-   না হলে আবার কি?বল না সন্টাই কবে নিয়ে যাবি?বিয়ার, রাম, হুইস্কি, কোনটা বেশি ভালো খেতে?কোনটা বেশি নেশা ধরায়?

-   ধুর! যা তো, ভাগ!

কলেজের চার বছর এক পলকে যেন পার হয়ে গেল। ক্যাম্পাসে সিলেকশনে চাকরী পেয়ে দু’জনে যখন দুই আলাদা শহরে আই.টি. কোম্পানীর কম্পিউটারে মুখ গুঁজতে বাধ্য হলো, বন্ধুত্বের সেই মজবুত বাঁধনের রাসটাও একটু একটু যেন আলগা হয়ে গেলো।

নতুন চাকরীর কাজ বুঝে নেওয়ার চাপ, নতুন শহর নতুন মানুষ চেনার চাপ,আরও এমন অগুনতি চাপের মাঝে বন্ধুত্ব হয়ে রইলো কিছু চ্যাট মেসেজ ও মাসে এক আধটা ফোন বা ভিডিও কল। জীবনে  যতটাই ভাবা যায় একরকম থাকবো, জীবন হয়তো কাউকে একরকম থাকতে দেয় না।

দেখা বা কথা কম হলে বন্ধুত্বের টান কিন্তু কখনো কম হয় না। সেই টন চিরকাল মনে এক থেকে যায়। মলি ও সন্তু এখন ও ফোন করলে সেই আগের বন্ধুত্বের স্বাদটাই কিন্তু ধরা পড়ে।

-   হ্যালো মলি, কেমন আছিস?

-   এত দিনে মনে পড়লো? চলছে, তুই বল...

-   একটা কথা ছিল, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রে, সামনের ডিসেম্বরে ২০  তারিখ। আগের থেকে বলে রাখছি ছুটি  নিয়ে এসে পড়বি,তুই আফটার অল আমার বিয়ের ইভেন্ট ম্যানেজার।

(এক দমেই কথা শেষ করলো সন্তু)

মলি, মলি, শুনতে পারছিস?

-   হুমম, আ -আছি, হঠাৎ বিয়ে? বলিস নি তো আগে?

-   আসলে ফিক্সড না হলে কি করে বলতাম বল? বাবা মা সমানেই বলছিল সেটেল হতে,তাই বললাম দেখো মেয়ে। অনুশ্রীকে দেখে আমার ভালো লাগলো, রাজি হয়ে গেলাম।

-   আমাকে একবারও বললি না?

-   এই যে বললাম। এখনও ছয় মাস বাকি। অনুশ্রী বড় ভালো মেয়ে রে। তোরও কথা বলে ভালো লাগবে।  

-   সে তো বলতেই হবে। নম্বর দিস, ওয়াটস আপে মেসেজ করে নেব।

-   মলি, তুই রাগ করে আছিস?

-   করা টা কি অস্বাভাবিক?

-   মেয়ে এমন করে বলছে যেন না হলে আমাকে বিয়ে করত, এখন মন ভেঙে ‘চান্না মেরিয়া’ গাইবে। তোকে তো বলেছিলাম, তুই তো...

-   আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তুই আমার ঘাড় থেকে নেমেছিস, শান্তি পেয়েছি, আর রাত দুপুরে জ্বালাবি না। এখন এক সপ্তাহ ছুটি প্ল্যান করতে হবে, কালকেই বলে রাখবো বসকে ।সন্টাইয়ের বিয়ে, টোপর মাথায় দিয়ে...

-   ধুর!তুই না... অনুকে বলবো তোকে মেসেজ করতে

-   ও হো, অনুশ্রী থেকে অনু... ছেলে পুরো ফর্মে।

-   বুঝেছি তুই এখন এভাবেই মাথা খাবি, আমি রাখছি।

আজ বসন্তের বিয়ে, মল্লিকা সত্যি ইভেন্ট ম্যানেজারের মতো সব দিকে নজর রাখছে। এখন সাত পাঁক ঘোরা হচ্ছে আর মল্লিকা চেয়ারে বসে দেখছে ও নিজের মধ্যে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। এ সময় শুধু নিজের সাথে কথা বলতে চায় মল্লিকা ও হিসেব মিলতে চায়। যেমন সিনেমায় দেখায়, আজ ওর মনে হচ্ছে যেন দু-দু’জন মল্লিকা কথা বলছে একে অপরের কাছে।

-   কী রে?খুশি তো?

-   খুশি না হওয়ার কি আছে? ভুলে যাস না, আমি ও কে মানা করেছিলাম। ও আমাকে দু’বছর আগে যে প্রপোজ করেছিল জন্মদিনে, মনে নেই?

-   কেন থাকবে না। গিফ্টয়ের সেই গোলাপী ক্লাচের ভেতর যে কাগজ রাখা ছিল, সে কাগজ তো তুই তুলে রেখে দিয়েছিস। কী কথা শুনিয়েছিলি ফোনে চিঠি পড়ার পর!

-   কি ভুল বলেছি? আমি ওকে শুধু বন্ধু ভাবি, কাছের বন্ধু ব্যাস। ওর মতো এই বোকা বোকা ছেলে মেযেগুলোই প্রমাণ করে যে একটা ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হয় না, দু’জনের মধ্যে একজন এর মধ্যে প্রেম ঢুকিয়ে পুরোটা নষ্ট করে দেবে।

-   আর তোর মতো যারা তারা কি প্রমাণ করে? তুই বুকে হাত রেখে বলতে পারবি যে তুই কখনও বন্ধুত্বের লাইন ক্রস করিস নি? তুই স্বপ্নে দেখিস নি দুজনকে কাছাকাছি, ঘনিষ্ট ভাবে...

-   চুপ!দেখেছি ও তারপর ঘুম ভেঙে গেছে...

-   জানি, এবং কেন তা ও জানি, স্বপ্নে ওর মুখটা সামনে এলেই তোর মোহভঙ্গ হয়।

-   সত্যি তাই, আমার কেন এমন হতো জানি না। শুধু মনে হয়েছে বিয়ের ফটোশুটে একসাথে কি বাজে লাগবে, ইনস্টাগ্রাম ফিড পুরো নষ্ট, আমার এক্সরা হাসা-হাসি করবে, কেন এমন মনে হতো জানি না, কিন্তু হয়েছে, এবং তাই নিজেকে নিচু মনে হয়েছে...

-   অথচ, তুই চিরজীবন ওকে বোঝালি যে রূপে কিছুই হয় না, আসল গুণ। সেই তুই কিন্তু দর্শনধারী থাকলি, কি প্রচন্ড মেকি!

-   জানি আমাকে খুব খারাপ মনে হচ্ছে। এই দু’বছর আমি অনেক ভেবেছি, কেন রাজি হলাম না, কিন্তু হেরে গেলাম। ওর প্রতি ভালোবাসটা যে সত্যি আমি জানি, এত বছর পুরোটাই কি শুধু নাটক?

কোল থেকে টুপ করে গোলাপী রঙের ক্লাচটি মাটিতে পড়তেই মলি যেন হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো থেকে এক লমহায় এসে দাড়ালো বিয়ের আসরে। সাতপাঁক ঘোরা শেষ। সিঁদুর দান পর্ব চলছে, ক্যামেরার ঝলকানিতে ভরে পড়েছে গোটা রুম। অনুশ্রীকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে, মল্লিকাকে কি এতটাই সুন্দর লাগতো?


 প্রবাহ পত্রিকার ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত (হাইলাকান্দি, অসম) । 

1 comment:

More to see...