May 25, 2020

ছায়াশরীর

@কমলিকা 

এ লেখার শুরুতেই অনেকটা ফিল্মি কায়দায় বলা ভালো যে কবিতার সঠিক মানে বোঝা ও বোঝানো "মুশকিল হি নহি, না মুমকিন হে"। কবিতা কোনো পরীক্ষার খাতায় লেখা কুড়ি মার্কের রচনা না যে পাতা ভরে লিখে ভূমিকা, মূলকথা ও উপসংহার ভাগ করে দিলেই কাজ চলবে।তা চেষ্টা করাও বোকামি মাত্র। নানা মুনির নানা মত প্রবাদের মতো কবিতা কি এবং কেন এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংজ্ঞা নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে এবং বলা ভালো যদিও আপাত দৃষ্টিতে দেখলে এই বিভিন্ন সময় ও অবস্থান বিভিন্ন মতের জন্ম দিয়েছে,সময়ের আতস কাঁচে কিন্তু সব একে অপরের পরিপূরক হয়েও দেখা দিয়েছে। এখানেই কবিতার রহস্যময়তা,কবিতার আসল ম্যাজিক। কবি কার্ল স্যান্ডবার্গ বলেছেন ,"কবিতা হলো এক প্রতিধ্বনি, এক ছায়াশরীরকে নাচতে বলার আবদার।" সেই প্রতিধ্বনি ওঠে কবির গহন মনে।দিনের কাজের ফাঁকে হঠাৎ আসে সে অলীক ডাক,আর কবি তাঁর সকল বাইরের জগৎ ছেড়ে মেতে ওঠেন নির্মানকলায়।


কবিদের এই কাব্যজগত কিন্তু বেশ মায়াবী স্বপ্নময়।তাঁর চোখের মাঝে যে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় তা সর্বসাধারণ থেকে আলাদা। এই যে আলাদা অনুভূতি,এটাই তফাত এক সাদামাটা বাক্য আর কবিতার শব্দবন্ধে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটি মজার উপমা দিয়েছেন কবিতা সম্পর্কে। উনি কবিতা রচনাকে সিংহ শিকারের সাথে তুলনা করেছেন। শিকারী খবর পেয়ে ছুটে যান সিংহ শিকারে।আদতে তিনি নিশ্চিত জানেন অব্দি না সেখানে সিংহ আছে কি নেই,থাকলে সঠিক স্থান কোথায়। অথচ শুধু শোনার উপর নির্ভর করে তিনি খুঁজে বেড়ান ও হয়তো পেয়েও যান কখনো। কবিরা তাঁদের জীবনযাপনে ঠিক এভাবেই ছুটে চলেন কবিতার খোঁজে।কেউ খুঁজে পায়,কেউ পায় না,সে অন্য গল্প;কিন্তু খোঁজটাই আসল।


কবিতা হলো কবি জীবনের ওয়েসিস।সাধারণ জীবনের নানা কাজের ফাঁকে একটু আশ্রয়স্থল।সেখানে সে একা বাসিন্দা,তাঁর দায় নেই সামাজিক বেড়াজাল রক্ষার, হাসি দেখিয়ে কান্না লুকোবার। সেখানে সে ঈশ্বরের বরপুত্র- শুভ্র, পবিত্র, শান্ত। যে জীবনে একবার এই রহস্যস্থল উদঘাটন করতে পেরেছে, বারবার সে ফিরে আসতে বাধ্য। এবং এর জন্যই হয়তো আমার কবিতা লেখা, কবিতাকে ভালোবাসা।


বাংলা কাব্যভূবনে অজস্র নক্ষত্রপুঞ্জ স্বমহিমায় বিদ্যমান।নতুন প্রজন্মের এই আমরা ভাগ্যবান যে অগ্রজরা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন এক বিরাট কাব্য সম্পদ। ভিন্ন দশকের ভিন্ন ফ্লেভার,ভিন্ন ধারা।এবার তাদের এই সম্পদকে সাথে নিয়ে নতুন ভাঙা গড়ার খেলায় নামটাই আমাদের কাছে সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ। সেই চির পরিচিত জীবন-মৃত্যু, প্রেম-বিরহ,শান্তি-সন্ত্রাস,সবই তো লেখা হয়ে আছে। তাই মাঝে মাঝে নিজের মনেই প্রশ্ন আসে কেন লিখবো? আসলে কবিতা হলো সেই 'বেস্ট ফ্রেন্ড ফরেভার' যাকে মন খুলে সব ভালো বা খারাপ লাগে বলা যায়।কিন্তু এই বলার কায়দাতেই লুকিয়ে আছে আসল ভানুমতির খেল। আমার যা বলার আছে বলবো, কিন্তু নতুন আঙ্গিকে।ধরা যাক,রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছেন ,উনি এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং যুগ সম্পর্কে জানতেন না, জানা সম্ভব ও নয়।তাই এ যুগের যে মানসিক দ্বন্দ্ব বা প্রতিঘাত , ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায় একটা এ যুগের কবিদের থেকেই যায়। জানি এটা স্থূল উপমা হলো কিন্তু পুরানো কে সাথে রেখে যুগ বদল ও মানসিকতা বদলের জন্যেই আজ আমরা হাসছি, কাঁদছি, ভালোবাসছি ও কবিতা লিখছি। খুঁজে চলেছি নতুন রূপ,নতুন রস,নতুন শব্দ। আমাদের সকলেরই বিভিন্ন পথ সম্মিলিত হয় সেই এক কাব্য ভুবনে। এ যেন অনেকটা এল-ডোরাডোর ধনসম্পদ খোঁজার আশায় ভাসানো নাবিকের নৌকো।গন্তব্যে পৌঁছুনো যাক আর নাই যাক- আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ।



প্রকাশিত ‘দৈনিক বজ্রকন্ঠ’ ব্লগ-পত্রিকায় ৩১.১২.২০১৮(আগরতলা, ত্রিপুরা)

No comments:

Post a Comment

More to see...