@কমলিকা |
‘কনফেশন’ বা ‘স্বীকারক্তি’ কথাটা মাথায় এলেই চোখে প্রথম ভেসে ওঠে গির্জার ভেতর বন্ধ ঘরে বসা এক মানুষ। তিনি মন ও মগজের সকল দ্বন্দ -দ্বিধা এক করে বলে চলেছেন অকপটে সকল সত্য কথা। মেলে ধরছেন সব অপরাধ বোধ যতনে এক এক করে। বন্ধ ঘরের লাগোয়া ঘরে সে কথা বসে একমনে শুনে চলেছেন এক পাদ্রী। শ্বেত শুভ্র বসন,হতে ক্রস ও রোজারি। সকল কথার পর পাদ্রী সাহেব যীশুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ভিক্ষা করেন। ওপারের অচেনা মানুষটিকে আদেশ করেন ভবিষ্যত কলুসমুক্ত রাখতে। এর পর যে যার কাজে বেড়িয়ে যায়। ব্যস ,এই টুকুনই গল্প।
এ দৃশ্য যতবার ফিল্মের পর্দা অথবা বইয়ে উঠে
এসেছে,ততবার ভেবেছি – বাহ্, কি সহজ সরল উপায় মনের ভাব লাঘব করার। কোন থানা-পুলিশ,
লোক-লজ্জা কিছুই নেই। তবে এই দৃশ্যটি আগের দিনেই দেখা যেত। আজকাল কনফেশন বক্সের
কথা প্রায়ে চোখেই পরে না। হয়তো মানুষ এখন নিজের মনের কথা নিজেকেই স্বীকার করতে ভয়
পায়। নিজের সৃষ্ট তোরঙ্গে তাই তলাচবী দিয়ে রাখে সকল দুঃখ, হতাশা, পাপবোধ।
সেই বক্সের অকপট স্বীকারক্তির সুত্র থেকেই
আমেরিকায় ১৯৫০ এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এক ধরনের কবিতার চল হয়, যার নাম কনফেশনাল
পোয়েট্রি বা কনফেশনালিসম্। বিখ্যাত কবি রবার্ট লয়েল, সিলভীয়া প্ল্যাথ , এনি
সেক্সটন, জন বেরীমোর, এবং অন্যান্য সেই সময় লিখে গেছেন একেরপর এক সব অসাধারণ
কনফেশনাল পোয়েট্রি। সিলভীয়া প্ল্যাথের
বিখ্যাত কবিতা ‘ড্যাডি’ কনফেশনাল পোয়েট্রির এক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
‘… If I’ve killed one man, I’ve killed two –
The vampire who said he was you
And drank my blood for a year,
Seven years, if you want to know
Daddy, you can lie back now …’
এ কবিতার প্রতিশব্দে তাঁর অকাল পিতৃবিয়োগ, পিতার প্রতি ঘৃণা ও তার
পরবর্তী বিভীষিকাময় জীবন ফুটে ওঠে।
কনফেশনাল পোয়েট্রিকে বলা হয় আমি-র কবিতা। এখানে
কবি নিজেকে ও নিজের হতাশা, উপলব্ধি, দুর্ভোগ আঁকে শব্দ তুলির ছোঁয়ায়। তবে এই
লুকানো দরজার কথাগুলোর মধ্যে কিন্তু কবি
তার চতুরতার ও বাগ্মিতার পরিচয় রেখে সাজিয়ে যায় এক অক্ষরের মায়াজাল, কবির একেবারে
নিজের মনের কথা তাই হয়ে উঠে পাঠকের মনের গভীর সংকেত।
যে স্টাইলটি বিদেশ একসময় নাড়িয়ে দেয়, অবাক ভাবে
ভারতে তার তেমন ছায়া নেই বললেই চলে। একমাত্র কবি কমলা দাস কে
বাদ দিলে আর কোনো কবিকেই আলাদা ভাবে কনফেশন পোয়েট আমরা পাইনি। কোমল দাসের ‘গ্লাস’
কবিতা তার জীবনে বিভিন্ন পরকীয়া সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে –
‘… I enter
others
Lives, and
Make of every trap of lust
A temporary home.’
সে ভাবে দেখতে গেলে বাংলা ভাষায় কনফেশনাল
পোয়েট্রি আলাদা কোনো জায়গা করতে পারে নি, তবে এই কথাও অস্বীকার করা যায় না – রাতের
সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। কবিতায় কবি তার সত্তা মিশিয়ে দেয় নিজের
অজান্তেই। তাই, কখনো কখনো সেখানে ধরে পড়ে
মনের গভীরে লুকিয়ে থাক কথা। যেমন কাজী নজরুল লিখেছেন তার সর্বহারা জীবন নিয়ে –
‘ ...বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা
হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম,প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে
আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায়
নিলাম।...’(যদি বাঁশি আর না বাজে)
উত্তরপূর্বের কাব্যভুবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে
দেশহীনের যন্ত্রনা। নিজের বাসভূমিতে জারজ অস্তিতের কথা ফুটে ওঠে বহু কলমে। কিন্তু
সেই কবিতগুলোয় সার্বজনীন দুঃখ পরিলক্ষিত হয়, অথবা কোনো কাল্পনিক (আদৌ কাল্পনিক নয়)
রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
এই দুঃখের জয়গাটাতেই আমরা কনফেশনাল পোয়েট্রির হাত
ধরতে পারি। নিজেদের অভিজ্ঞতা, চাওয়া-পাওয়ার ফারাক, স্বপ্ন ও বাস্তব জগত কে এক করে
লিখতে পারি ‘ আমি- র’ কবিতা, ‘আমার’
কবিতা, ‘আমাদের’কবিতা। কিছু দিন আগে মিয়া কবিতার বহুল প্রচার সে দিকেই ইঙ্গিত
দিয়েছিল, কিন্তু ইঙ্গিত আর বাস্তবায়িত হয় নি। এখন সময় শুধু অপেক্ষার।
কনফেশনাল
পোয়েট্রি কোথাও কোথাও নিন্দিত হয়েছে ‘নারসসিসম’-এর দায়। নিজের প্রতি অতিরিক্ত
ভালোবাসা ও বাকি সকলকে উপেক্ষা করা- এই বিষয়টি সমাজ সে ভাবে মেনে নিতে পারেনি। আর
তাই হয়তো এর আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে কোনো এক গোপন চেম্বারে থেকে গেছে এক নিস্তব্ধ
প্রদীপ হয়ে। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো এক পথিক এসে এর সলতে একটু উসকে দিয়ে যাবে, আমরা থাকবো সেই প্রতীক্ষায়।
প্রকাশিত হয় অন্তঃকরণ পত্রিকার ৬ষ্ঠ সংখ্যায়, ফেব্রুয়ারী ২০২১ (আগরতলা, ত্রিপুরা)