-
কী
আর করবো? রোজ অংক কষছি আর ভিডিও বানাচ্ছি । এভাবে অনলাইন কি আর পড়ানো যায়? ...
আরে বাবা পিপিটিও বানিয়েছি। ভাল্লাগেনা এই জ্বালা।...
আজই তো আরও দু’সপ্তাহ বাড়িয়ে দিলো । এই সেশন
এভাবেই যাবে দেখবি।...
আসলে ভাবছে টিচারদের কেন বেকার টাকা দেবো,
একটু খাটিয়ে মারবো না? ...
চল রাখছি, এখন তো আবার পচার মা মোড অন। মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু
মেরে ঝেটিয়ে বিদায় কর...
@কমলিকা |
বৌমার টুকরো টুকরো কথাগুলো কানে আসছে সুধাময়ীর। কথাটা
অবশ্য মিথ্যে বলেনি। এই গৃহবন্দিনী হওয়ার পর থেকে প্রভা নিজেই ঝাড় -পোঁচ চালাচ্ছে,
আর উনি নিয়েছেন রান্নাঘরের দায়ভার। আসলে রাঁধতে সুধা বরাবর ভালোবাসেন। তবে ক'বছর
আগে শুভ জোর করলো- মায়ের বয়স বেড়েছে,আর কেন গরমে তেতে পুড়ে সিদ্ধ হওয়া? এরপর ঘরে
কুক এলো,ব্যস সুধার হাতে রিটায়ারমেন্ট লেটার। তাছাড়া কুক চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল,মেক্সিকান,কত
কি জানে? আর সুধা, সেই তো থোড়-বড়ি-খাড়া আর
খাড়া-বড়ি-থোড়। ওসব সেকেলে খাবার গেস্টদের খাওয়ালে কী প্রেস্টিজ থাকে?
এই লক-ডাউনে ঠিক কতজন জ্বালাময় জীবন পেয়েছে সুধা জানেন না, কিন্তু সে নিজে তুখোড় ভাবে উপভোগ করছেন।
শুধু খুশিটা বাইরে প্রকাশ করেন না- এই যা। রোজ সকালে রামকৃষ্ণ দেবের ছবিতে একবার
বলেও ফেলছেন, - ঠাকুর রোগ ঠিক করে দাও তবে পারলে এই লক-ডাউন আরও কিছু দিন
রেখো,সকলেরই তো একটু ছুটির দরকার।
খুশি হবেন নাই বা কেন? সেই কলেজে পড়ার পর শুভটা আর কখনো
এতদিন ঘরে রয়েছে? ছেলে,বৌমা,নাতি সব এখন ঘরে,তাঁর কাছে, এর থেকে আনন্দ আর কি
কিছুতে থাকতে পারে? রোজ মনের মতো যা নিরামিষ পদ বানাচ্ছেন , সকলে সোনামুখ করে খাচ্ছে। টুকাইটা তো কাল জিজ্ঞেস করেই ফেললো
ঝিঙে-পোস্ত খেয়ে, - ঠাম ,এই হোয়াইট বলসগুলো কি কোনো ভেজিটেবল?
শুভ মানে শুভপ্রসন্ন
চ্যাটার্জী বিশাল আইটি কোম্পানীর এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। নামেই ঘরে আছে, সকাল থেকে রাত কাপের পর কাপ ব্ল্যাক
কফি ও ল্যাপটপে মুখ গোঁজা,কানে হেডফোন। জীবনের সেনটেন্সে শুধু লাঞ্চ ,ডিনার,স্নান,
ঘুম, ও ব্রেক, এই পাঁচটে অল্পবিরাম,যাকে বলে কমা, সাজানো। স্ত্রী ইন্দুপ্রভা এক
ডাকসাইটে স্কুলের ম্যাথস টীচার। দিন কাটছে
অনলাইন ক্লাস ও ইউটিউব, ফেসবুক করে, মাঝে মাঝে দু একটা ভিডিও কল। ছেলে সূর্যপ্রভ
মানে টুকাইয়ের বয়স সবে পাঁচ। তার বিশেষ কাজ নেই। কিন্তু বাপী-মামকে শান্তিতে কাজ
করতে দেওয়ার জন্যে তাকেও দেওয়া হয়েছে একটা ট্যাব । কার্টুন,গেমস্ ,রাইমস্ ,কি নেই
এইটুকুন বাক্সে ? সুধাময়ী দেখেন আর ভাবেন কম্পিউটার চালানো শিখে ফেললে বেশ হত
,উনিও তাদের একজন হয়ে উঠতে পারতেন। স্ক্রিন টাচ মোবাইল বৌমা শিখিয়ে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু
ছুঁলেই কেন যে ভয় পেয়ে বসে -অত দামী জিনিস, যদি কিছু হয়।
তার চাইতে টিভি ভাল,ঐ বাংলা সিরিয়ালগুলো ভাল। তবে এই একটা
জিনিস সুধার একেবারেই ভাল লাগছে না। আজকাল একটা সিরিয়ালও নতুন এপিসোড দেখায় না। সব
পুরোনো শেষ হওয়া সিরিয়ালের রেকর্ডিং ক্যাসেটে ধুলো ঝাড়ছে আর চালাচ্ছে। কিন্তু তবুও
কিছু পাওয়ার জন্যে কিছু ছাড়া যেতেই পারে। নাহয় তিন তিনটে মুখ যখন ইচ্ছে দেখার
জন্যে সুধা ঐ সিরিয়ালগুলোর মায়া ত্যাগ করলেন।
টিং-টং ,টিং-টং
-
এই
দুপুরবেলা আবার কে এলো?ভাবলাম একটু রেস্ট নেই, এখন কনফারেন্স নেই, কার সাধ্য ? আসছি রে বাবা আসছি। মা তুমি কিন্তু
আবার দরজা খুলতে চলে যেও না।
সুধার এই কথাতে প্রথম প্রথম একটু মানে লাগতো, এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। এই রোগে বৃদ্ধেরা না কি বেশি রিস্কে ,তাই আজকাল সুধার দরজা খোলা
মানা। যেন সেই ষাটের দশকের ঘর,শুধু জওয়ান পুরুষ দরজা খুলবে,বাকি সব অন্দরে। সুধার
মাঝে মাঝে মনে হয় শুভকে বলতে, ওনার আর শুভর ইমিউনিটি টেস্ট হলে উনি জিতবেন,নিশ্চিত।
শুভই দু দিন অন্তর হয় জ্বর, নাহলে মাথাব্যাথা, না হলে অন্য কিছু নিয়ে কাড়িকাড়ি
ওষুধ গেলে।
-
কে
, কী চাই?
-
দাদা,
আমি কালু, একটু দরজা খুলেন না,কাম আসিলো।
শুভ দরজা খুললো বটে কিন্তু ল্যাচটা রইলো যথাস্থানে, বলা তো
যায় না।
-
কালু
মানে, ঐ পাড়ার হরি মুদির দোকানের কালু? তোকে তো চিনতেই পারিনি আমি। এরকম
টেরোরিষ্টের মতো পুরো আপাদমস্তক ঢেকে এসেছিস যে। বৌদি বা মাসি কি ফোনে কিছু আনতে
বলছিল ?
-
(একটু
লজ্জা পেল মনে হলো) কী করুম কন দাদা?সবে কয় মাস্ক পর,কই কই ঘুরস,আমাদের ঘরে এরপর
তুই অসুখ ঢুকাবি দেখতেসি। দাদা, একটু মাসিমারে ডাইক্কা দেন না।
-
কেন?
আমাকে বল, কী কাজ?
-
না
দাদা, মাসিমারে ডাকেন, একটু দেইকখা যামু গিয়া, দূরে থাকুম বিশ্বাস করেন।
শুভ মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো। ইচ্ছে করছে মানা করে
দিতে,কিন্তু ওদের এখন হাতেও রাখতে হবে।
ওসব মল, অনলাইন ডেলিভারী সব বন্ধ, এখন এই কালু না করলে শেষ মেশ শুভকেই চলের
বস্তা বইতে হবে। নিশ্চয়ই টাকা চাই। ঠিক
বুঝেছে ছোঁড়া যে শুভ অতো সহজে গলবে না,তাই মায়ের খোঁজ। মায়ের এই বোকা বোকা ভালমানুষী শুভর জাস্ট সহ্য হয় না।
গরীব শুনলেই হয়ে গেল, পারলে কোলে বসিয়ে ভাত খাওয়াবে। বোঝানোই যায় না এগুলো এখন
অচল, লোকে ফায়দা লুটে, যেমন এখন এই কালু এসেছে। মাকে আচ্ছা করে বলে দিতে হবে ৫০
টাকার বেশি যেন না দেয়। সরকার সব তো দিচ্ছে, এদের স্বভাবটাই হচ্ছে পরের মাগনা খাওয়া।
-
কি
রে কালু,আমার খোঁজ করছিলি ? তুই তো মাসি কে ভুলেই গেছিস, দরজা থেকেই চলে যাস আজকাল।
-
না
মাসিমা, সবে কয় বুড়াগো সমলাইয়া থাকতে, তাই ডাকি না। আপনে ভাল থাকেন, এইটাই তো চাই কন।
-
তা
ডাকছিলি কেন সেটা তো বললি না এখনো। কী হয়েছে,হাতে টাকা নাই ? খেয়েছিস কিছু আজকে?
-
না
না মাসিমা, আপনেরে দেখতে মন বড় টানতেসিলো, তাই আইলাম। এখন দেখসি , যাই গিয়া।
-
মানে?
আমাকে দেখতে? বুঝলাম না। সত্যি বল তো কালু কি হয়েছে।
-
মাসিমা,
আপনেরে মিসা কমুনা । আপনেরে কইসিলাম না
গ্রামে আমার মা একলা থাকে, আর আমি এইখানে। মারে আমি এক দিন বাদ দিয়া পরের দিন দুপুর
বারোটায় সঞ্জয়দার দুকানে ফোন করতাম। সঞ্জয়দার আমাগো পাড়ায় জামা-কাপড়ের দুকান, অনেক
বড়লোক। আমি সঞ্জয়দারে রাজি করসিলাম যে আমি ফোন করুম, মারে একটু কথা কইতে দিব, মাসে
৫০ টেকা দিমু। এখন ২১ দিন ধইরা দুকানও খুলে না, মায়ে
ফোনও ধরে না। মারে খুব মনে পরতেসিলো। মনে হইলো আপনেরে দেইখা যাই। আপনে যখন
ভাল আসেন, মা ও ভালই থাকবো, তাই না কন?
এখন প্রায়ে রাত ১১টা। সুধাময়ীর চোখে ঘুম নেই। দরজা বন্ধ
করে যখন আড়ি পাতা শুভকে বলেছিলেন টাকা লাগবেনা,তখন কি তাঁর গলা কাঁপছিল? শুভ তো
তার সুযোগ্য ছেলে,সবে তাঁকে রত্নগর্ভা বলে, তবে কেন আজ হিংসে হলো মনে? মায়ের মনে
কি আদৌ হিংসে হয়? কি সব ভাবছেন আকাশ পাতাল
আজ। সব ঐ হতচ্ছাড়া সিরিয়ালগুলোর জন্যে। বেশ টাইম পাস হত, এখন সারাটা সন্ধে
আলসেমিতে কাটে আর রাতে ঘুম হাওয়া। হাত জোর করে বিড়বিড় করলেন সুধাময়ী – ঠাকুর,
সিরিয়ালগুলো শুরু করিয়ে দাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, লক-ডাউন উঠিয়েই দাও, খুব বাজে
কাটছে দিনগুলো।
ফেসবুকে পোস্ট ০৩.০৫.২০২০ ।
No comments:
Post a Comment